অলৌকিক

0
342

ছোটবেলার অনেক কথাই ভুলে গেছি। কিন্তু সেই ঘটনাটি আমি ভুলতে পারি না। কথাটি আমি কাউকে বলিনি। এরকম কথা কাউকে বলা যায় না!

আমি তখন নবম শ্রেণিতে পড়ি। আমাদের স্কুলটা আমাদের গ্রাম থেকে এক কিলোমিটারের মত দূরে ছিল। ইউনিয়নের মধ্যে সেটাই একমাত্র স্কুল ছিল। তাই আশেপাশের গ্রামগুলোর সবাই সেই স্কুলেই পড়তে যেত। আমাদের গ্রাম থেকে একটা লম্বা কাঁচা রাস্তা ধরে যেতে হত।

সেদিন ছিল শনিবার। স্কুল শেষে একটা কাজ আমাকে দুই ঘণ্টার মত স্কুলে থাকতে হয়েছিল। স্কুলের এক স্যারের কাজেই আমাকে থাকতে হয়েছিল। কাজ শেষ হতে হতে ওই স্যার আর আমি ছাড়া স্কুলের বাকি সবাই চলে গিয়েছিল। কাজ শেষ করে আমি স্কুল থেকে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলাম। একা একা হাঁটছি। ভালো লাগছিল না। স্কুল থেকে ফেরার সময় রাস্তাটায় ছাত্রছাত্রীদের ভিড় থাকায় অন্যান্য দিন তেমন খারাপ লাগত না। তবে সেদিন একা রাস্তা পার হতে সত্যিই খারাপ লাগছিল।

হঠাৎ লক্ষ্য করলাম, আমার পেছনে অন্য কারো পায়ের আওয়াজ শুনা যাচ্ছে। পেছনে তাকাতেই দেখি রুপা। এতক্ষণ কেন লক্ষ্য করিনি বুঝতে পারলাম না!

ও আমাদের ক্লাসেই পড়তো। পড়াশুনায় খুব ভালো। দেখতেও বেশ মিষ্টি ছিল। স্কুলের বড়ো ভাইয়েরা আর ক্লাসের লম্বা লম্বা ছেলেগুলো ওর পেছনে লেগে থাকতো সবসময়। রোদ ছিল। তবে প্রচণ্ড বাতাসে ভালোই লাগছিল। লক্ষ্য করলাম, রুপা অনেকটা লম্বা লম্বা পা ফেলেই আমার সঙ্গ ধরেছিল। আমরা কিছুক্ষণ রাস্তায় একই সাথে, একই গতিতে হাঁটছিলাম। কথা বলার ইচ্ছা হচ্ছিল। তবে সাহস করে ওর সাথে কথা বলতে পারছিলাম না। আমি মেয়েদের সাথে সহজে মিশতে পারতাম না। সুন্দরীদের সাথে তো না ই।

একটা সময় রুপাই বলল, ‘কী ব্যাপার রনি। আজ এত দেরি করে ফিরছ যে!”

কথা বলার সুযোগ পেয়ে ভালো লাগলো। আমি আগ্রহ নিয়ে বললাম, “ওই… মানে, সেলিম স্যার একটা কাজে আটকে রেখেছিলেন। তাই দেরি হয়ে গেল। তোমারও তো অনেক দেরি হল দেখছি। তুমি কি করছিলে?”
– আমাকে হেড স্যার কিছু এম সি কিউ পেপার দেখার জন্যে আটকে রেখেছিলেন।
– ও।

আরও কিছুক্ষণ চলে গেল। আমরা এগিয়ে যাচ্ছিলাম। মাঝে মাঝে দু’একজন গরুর পাল নিয়ে রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিল। রুপার চুলগুলো বাতাসের ছন্দেই নৃত্য করছিল। সে একহাতে চুলগুলো সরানোতে ব্যস্ত ছিল। কী অদ্ভুত মায়াময় সে দৃশ্য!

রুপা মৃদু হেসে বলল, “তুমি এতো কম কথা বল কেন রনি? সবসময় চুপ মেরে থাকো।”
আমি হেসে বললাম, “আমি বেশি কথা বলতে পারি না। তবে, এতটাও যে চুপ থাকি, তা কিন্তু না।”
“তা ঠিক। সেদিন মঞ্চ নাটকে যা অভিনয় করেছিলে। আমার সত্যিই খুব ভালো লেগেছিল। এত বছর ধরে তোমাকে লক্ষ্য করছি। নাটক নিয়ে যে সময় তুমি ব্যয় করো, জিনিসটার প্রতি তোমার প্রেম স্পষ্ট ধরা পড়ে।”

আমি বললাম, “থ্যাংকস। নাটক লিখতে, অভিনয় করতে আমি ভালোবাসি। তবে তুমি বাড়িয়ে বলছ। আর তুমি যে আমার নাটকের ব্যাপারটা সেভাবে লক্ষ্য করেছ, সেটা জানতে পেরে ভালো লাগছে। কোন নাটকটার কথা বলছ? ওই যে ভূত নিয়ে করেছিলাম, ওইটা?”
– হ্যাঁ, হ্যাঁ। খুব ভালো লেগেছিল। আচ্ছা, রনি, একটা প্রশ্ন করবো?
– করো।
– তুমি ভূতে বিশ্বাস করো?
আমি মৃদু হেসে বললাম, “আসলে, যারা ভূতের গল্প লিখে, তাদের বেশিরভাগই সেটা বিশ্বাস করে না। অন্যের বিশ্বাসকে ধারণ করেই লিখে।”
রুপা আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “কেন বিশ্বাস করো না?”
আমি একটু শিক্ষকদের মতো করে বললাম, “দেখো রুপা, আমাদের ছোটবেলা থেকে নানানভাবে ভূতের গল্প আর নানান অন্ধবিশ্বাস গেলানো হয়। সেকারণেই এসবের প্রতি আমাদের বিশ্বাস জন্মে যায়। পরবর্তীতে সত্য জানার মতো অনেক ব্যাপার থাকলেও, আমরা ওইসব অন্ধবিশ্বাস থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত হতে পারি না। অথবা চাইও না। মানুষ যুক্তি পছন্দ করে না। গুজব আর কাহিনী পছন্দ করে। তাছাড়া, ভূতের ব্যাপারটা আমাদের ইন্দ্রিয়ের সাথেও সম্পর্কিত। যতক্ষণ ইন্দ্রিয়গুলো সজাগ, ততক্ষণ ভূতের ভয় থাকবে। অপেক্ষাকৃত কম সক্রিয় থাকলে, করবে না।”
– বাহ! দারুণ বলেছ। প্রথম কথাটা বুঝলাম। তবে, ইন্দ্রিয়ের সাথে সম্পর্কিত মানে?
– মানে, ধরো তোমার গ্রামে যেতে একটা কবরস্থান অতিক্রম করতে হয়। বহুদিন ধরে প্রচলিত ওইখানে ভূত থাকে। এখন যদি তুমি নির্জন রাতে সে রাস্তায় কবরস্থানের পাশ দিয়ে যাও, তোমার ভয় করবে। কারণ, তোমার মনে এতদিনের ভূতের ধারণাগুলোকে মস্তিষ্ক ক্রমাগত সামনে নিয়ে আসবে। যদি তুমি ভূত ভয় পেয়ে থাকো অবস্থা এমন হবে যে হঠাৎ একটা সাদা কাপড় উড়ে যেতে দেখলে, তোমার মনে হবে কোনো মহিলা সাদা শাড়ি গায়ে উড়ে চলে যাচ্ছেন। কোনো পশুর ছায়া অথবা তোমার নিজের ছায়াই আলোর অবস্থানের কারণে রাস্তায় বড়ো দেখা যেতে পারে। যা দেখে তুমি বড়ো ভূত মনে করে ভয় পেয়ে যেতে পার। কিন্তু একজন লোক যে তোমার মতোই ওই স্থানের ভূতের ব্যাপারটা বিশ্বাস করে, যদি নেশা করে ওই স্থান অতিক্রম করে, তার মাঝে ভূতের ভয় কাজ করবে না।

রুপার চোখে কিছুটা বিস্ময়। তবে মৃদু হাসিও আছে। এক রহস্যময় হাসি! মৃদু হেসেই সে বলল, “ভূত নিয়ে অনেক সত্যি কাহিনীও তো প্রচলিত আছে রনি। তাই না?”
– সরি রুপা। আমি তা মনে করি না। আমি মনে করি, ভূত নিয়ে যতো গল্প প্রচলিত তার বেশিরভাগই কেউ না কেউ কোনো স্বার্থে ছড়িয়ে থাকে।
– মানে!
– মানে, ধরো গ্রামের প্রান্তে একটা বড়ো পুকুর আছে। সেখানে বড়ো মাছও পাওয়া যায়। সেই মাছ অনেকেই খেয়ে ফেলতে পারে। তাই কিছু লোক নানান কৌশলে একটা গুজব ছড়াবে যে ওখানে ভূত আছে। তাদের একজনকে টেনে নিয়েছিল, অনেক কষ্টে বেঁচে গেল, ইত্যাদি। তারাই আবার রাতের অন্ধকারে সেখানে গিয়ে মাছও ধরবে।
রুপা হাসতে হাসতে বলল, “ভালো বলেছ। ভালো।”

মেয়েরা অতিরিক্ত হাসলে মুখ আড়াল করে। রুপাও মুখ আড়াল করার জন্য হাত উপরে তুলল। তখনই দেখলাম, তার হাতে দুটো ছিদ্রের চিহ্ন। আমি বললাম, “এটা কিসের দাগ রুপা?”
রুপা বলল, “আর বল না। আজ স্কুলে শারমিন কম্পাস দিয়ে ফুটো করে দিয়েছিলো। যা ব্যাথা পেয়েছিলাম!”
– ইশ রে! ওর সাথে তোমার কথা কাটাকাটি হয়েছিলো আমরা লক্ষ্য করেছিলাম। কিন্তু এভাবে ফুটো করে দিবে ভাবিনি। কাজটা ঠিক হল না।
– না। তেমন কিছু না। বাদ দাও। একটা জিনিস লক্ষ্য করেছ রনি?
– কী?
– আজ এত বছর আমরা একই স্কুলে, একই ক্লাসে পড়ছি, অথচ আমাদের এতক্ষণ এতো চমৎকারভাবে গল্প করা হয়নি কোনোদিন!
– তা ঠিক!

এমন সময় বাতাসের বেগও বেড়ে গেলো। ওই পরিবেশে রুপাকে এতটাই আকর্ষণীয় লাগছিল যে চোখ সরানো যাচ্ছিল না। আমার হাতে একটা খাতা ছিল। হুট করে সেটা উড়ে গিয়ে পড়লো রাস্তার পাশের ধানের জমিতে।
রুপা বলল, “ইশ রে! পড়ে গেলো!”
আমি কিছুটা লজ্জা পেয়েই বললাম, “সমস্যা নেই। আমি নিয়ে আসছি। তুমি দাঁড়াও।”

আমি ধানের জমিতে নেমে খাতাটা উদ্ধার করলাম। বাতাসে বেশ দূরেই চলে গিয়েছিল সেটা। এর মধ্যে পানিতেও ভিজে গেছে। উদ্ধার করতে কিছুটা সময় চলে গেলো। গণিতের খাতা। ফেলেও আসা যেত না। কিন্তু খাতাটা নিয়ে যখন রাস্তায় এলাম, রুপাকে আর দেখতে পেলাম না। একটা রিকশা দেখা যাচ্ছিল কিছুটা দূরে। তবে কি সে ওই রিকশায় চড়ে চলে গেলো? আমাকে না বলে এভাবে চলে যাওয়াটা ঠিক হল!

মন ভীষণ খারাপ হয়ে গেলো আমার। অবশ্য কিছুটা দূর গিয়ে রুপার এমনিতেই অন্য রাস্তা ধরতে হত। সে অন্য গ্রামে থাকে। সামনের মোড়ে গিয়ে দুই দিকে দুই রাস্তা গেছে। একটা রাস্তা ওদের গ্রামে যায়। বেশ দূরে ওদের গ্রাম। অন্যান্য দিন বান্ধবীরা থাকে। আজ একা একা যাচ্ছে। তাই হয়তো রিকশা ধরেছে। এসব চিন্তা করেই আবার আমি রওয়ানা হলাম।

সেদিন বাড়িতে ফিরে গোসল করার পর থেকেই জ্বরজ্বর লাগছিল। ভাত খাওয়ার ইচ্ছে হল না। জ্বর বেড়ে গেলো। ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসছিল। আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। বলতে গেলে এক ঘুমেই রাত শেষ হয়েছিল। সকালে ঘুম থেকে উঠার মা বলেছিলেন উনি নাকি ঘুম থেকে তুলে একবার আমাকে সামান্য খাইয়ে দিয়ে ওষুধও খাইয়ে দিয়েছিলেন!

সকালে উঠার পর কিছুটা সুস্থ লাগছিল। আমিও স্কুলে গেলাম। স্কুলে গিয়ে দেখি এক বিশাল জটলা। চেঁচামেচি, কান্নার আওয়াজ। কিছুই বুঝতে পারলাম না। তখনই আমার দুই বন্ধু রাজু আর সুজয়ের সাথে দেখা হল। আমি তাদের বললাম, “কী রে? কী হয়েছে?”
সুজয় বলল, “আমাদের ক্লাসের রুপাকে তো চিনিস? সে মারা গেছে।”
প্রথমে মনে করলাম, ওরা মজা করছে। আমি বললাম, “কেন মজা করছিস বল!”
রাজু ছলছল চোখেই বলল, “মজা না রে। আজ স্কুলে এসেই ওর লাশ পাওয়া গেলো। গতকাল সাপে কামড় দিয়েছিল।”

তখন আমার মাথা ধরা আবার বাড়তে থাকলো। বুকের মাঝে চিন চিন ব্যথাও শুরু হল। কোনো হিসাব মেলাতে পারছিলাম না। আমি ওদের বললাম, “কখন ঘটলো ঘটনাটি?”
রাজু বলল, “স্কুল ছুটির পরই হবে। লাস্ট ক্লাস অবধি তো একসাথেই ছিলাম আমরা।”

আমি কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলাম না। বুকের ব্যাথাটা অদ্ভুতভাবে বাড়তে থাকে।

আজ দীর্ঘ ৫৩ বছর পর এই ঘটনাটি কেন জানি ভীষণ রকম মনে পড়ছে! সেদিনের অদ্ভুত ব্যাথাটা আজও হচ্ছে!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here