কন্ট্যাক্ট লেন্স

1
437

মেঘে ঢাকা মন খারাপ করা আকাশের মত পড়ে থাকে মায়াবী চোখজোড়ায়। যে নয়নযুগলের কল্যাণে হয়তো সৃষ্টি হতে পারতো আরও এক মহাকাব্য।
জীবনানন্দ দাশের মতো কেউ হয়তো আবার বলে উঠতো-
“চোখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য”
মুখশ্রী বাদ দিয়ে হয়তো চোখ নিয়েই নতুন আগামীর সূচনা করে ফেলতো!

কিন্তু না, ঘন কালো মেঘ যেমন পুঞ্জীভূত হয়ে পরিষ্কার নীল আকাশকে ছেঁয়ে রাখে; ঠিক তেমনি পুরু এক কাচের দেয়াল মাধবীর প্রচণ্ড মায়াবী চাহনীকে ঢেকে রাখে। প্রাত্যহিক কর্মকাণ্ডের মতো চশমা নাকের ডগায় বসে পৃথিবীর বিভিন্ন লীলা অবলোকন করছে।

সদ্য স্নাতকোত্তরে ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থী মাধবী। স্নাতক সম্পন্ন করে শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষা দিয়ে একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা হিসেবে কর্মরত আছে। পাশাপাশি ইংরেজিতে স্নাতকোত্তর চালিয়ে যাচ্ছে।

একদিন মাধবী নিজের মাকে চোখের দুরবস্থার কথা জানালো। দৃষ্টি ক্রমশ ক্ষীণ হয়ে আসছে। চশমার পাওয়ার কেবল মাইনাস হচ্ছে। সে সাত-আট ফুট দূরের কোনো কিছু এমনকি মানুষের মুখটা পর্যন্ত দেখতে পায় না।

কী হবে মাধবীর এই চোখ নিয়ে! আপনমনে ভাবে সে। মাধবীর মা তেমন শিক্ষিত নয়। তাই অপারেশনের ব্যাপার তেমন বুঝে উঠতে পারে না। শুধু দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন চন্দনা ঘোষ- ‘যা ভালো মনে হয় করিস মা। আমি মূর্খ মানুষ অত জটিল ব্যাপার বুঝি না’।

এরই মাঝে মাধবীর মা ঘোষণা করলেন যে তিনি মেয়ের বিয়ে দিবেন। মেয়ের জন্য একজন সুযোগ্য পাত্রের খোঁজ পেয়েছেন। নাম দীপন চৌধুরী, মহেন্দ্র চৌধুরীর ছেলে। আই স্পেশালিস্ট, কানাডা থেকে ফিরেছে কিছুদিন হলো।
– কিন্তু মা…
– কোনো কিন্তু নয়। শিক্ষকতা করছো আর পরেও করবে। তাতে তাদের কোনো অসুবিধা নেই। বিয়েটাও এর চেয়ে কম জরুরি নয়।

মাধবী কেবল ভাবছে, চোখটা নিয়ে কী করবে! অবশ্য দীপন বাদে বাড়ির লোকেরা দেখে গেছে তাকে। প্রতিটি মুহূর্তেই চশমার প্রয়োজন। ব্যাপারটা এমন যে, চশমাই ত্রিনয়ন হয়ে গেছে।

পাত্রের বাড়িতে মাধবীর একটি ছবি আগেই পৌঁছে গেছে। বিশেষত ডাক্তারবাবু দীপনের দেখার জন্য।
দীপন ছবি দেখেই মাধবীকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে। কাজলকালো চোখ, সুন্দর কেশবিন্যাস মায়াবী মুখ দেখে কিছুক্ষণের জন্যে কানাডার পিছুটান যেন ভুলে গেল দীপন। মোটের ওপর, এমন ডাগর চোখের মায়াবিনীকে পারতপক্ষে হারাতে চায় না সে।

চৈত্র মাসের শেষের দিকে দীপন ও তার বাড়ির লোকেরা মাধবীদের বাড়িতে এলো। উদ্দেশ্য দুই পরিবারের আত্মিক বন্ধন আরো সুদৃঢ় করা। যেহেতু দুই পরিবার থেকেই বিয়ের আয়োজন করা হয়েছে সেহেতু আংটি পরানোর মাধ্যমে চূড়ান্ত দেখা সম্পন্ন করা হবে।

ইতিমধ্যেই মাধবী ও দীপন দু’জন দু’জনকে ছবিতে দেখেছে। এইবারই প্রথম সরাসরি দেখার সুযোগ মিললো।

দীপনের মনে ক্ষীণ শঙ্কা ছিল এই যে, যদি মেয়েটির কোনো সম্পর্ক থাকে এবং বিয়েটা প্রত্যাখান করা হয়। তবে সকল শঙ্কা কাটিয়ে অবশেষে বুকের দুরুদুরু কাঁপন বন্ধ হলো। কারণ মাধবী বিয়েতে মত দিয়েছে।

চমৎকার একটি মধ্যাহ্নভোজের মাধ্যমে আংটি পরানোর পর্ব শেষ হলো। দীপনের খালাতো বোন সুমনা এরই মধ্যে মাধবীর সাথে আলাপ করে নিয়েছে। আরেকটি দুর্দান্ত কাজ করেছে সে। মাধবীর মোবাইল নম্বর জোগাড় করে এনেছে ভাইয়ের জন্য। যদিও এই মুহূর্তে নম্বর নেওয়া তেমন কঠিন কোনো ব্যাপার নয়। তথাপি লজ্জার মাথা খেয়ে দীপনের পক্ষে বিয়ের পাত্রীর নম্বর চাওয়া সহজ ছিল না।

রাত্রিবেলায় সুমনাকে পাক্কা এক হাজার টাকা ঘুষ দিয়ে মাধবীর মোবাইল নম্বর নেওয়া সম্ভব হলো। হৃৎপিণ্ড সজোরে ক্রমাগত কম্পিত হচ্ছিল। মেয়েটির সাথে কী বলে কথা শুরু করবে মনে মনে কেবল সেটাই ভাবছিল দীপন।

প্রথমবার রিং হয়ে বন্ধ হয়ে গেল। ওপাশ থেকে সাড়াশব্দ নেই। দ্বিতীয়বার রিং হওয়ার পর ফোনের অপরপ্রান্ত থেকে একটি মিষ্টি কণ্ঠ ভেসে এলো।

– হ্যালো, আসসালামু আলাইকুম
– ওয়ালাইকুমুস সালাম, আপনি কি মাধবী বলছিলেন?
– জি বলছি। আপনি কে বলছেন?
– আমি দীপন বলছি। আজ যার সাথে আপনার আংটি বদল হলো।

কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর…
– ওহ! আপনি। বুঝতেই পারিনি।
– হুম, না বোঝারই কথা। কারণ আপনার কাছে আমার ফোন নং নেই।
– হ্যাঁ, তা অবশ্য ঠিক। আপনি কি কিছু জানানোর জন্য ফোন করেছেন?
– না, ভাবলাম যে বিয়ের আগে আপনার যদি আমার সম্পর্কে কিছু জানার থাকে। তাই আর কী।
– ওহ আচ্ছা। ফোনটা যখন করেছেন তখন আমার সম্পর্কে কিছু গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার জানানোর প্রয়োজন বোধ করছি।

ডা. দীপনের বুকটা ধক করে উঠলো। না জানি মেয়েটি বিয়েতে মানা করে দেয়। কিন্তু বিষয়টা ছিল সম্পূর্ণ উল্টো।

মাধবী চোখে ভালো দেখতে পেত না। চশমা ছাড়া তার দৃষ্টি ক্ষীণ সে কথাটি বললো। এমনিতে খোলা চোখে সে প্রায় অন্ধ বলা চলে।

বিয়ে মানুষের জীবনে একবারই হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে নিজের খুঁটিনাটি সকল বিষয় জানানো তার কাছে জরুরি বলে মনে হলো।

সবকিছুই মন দিয়ে শুনলো দীপন চৌধুরী। তবুও ভাবলেশহীন রইল। তার কোনো বিচলতা নেই এসব নিয়ে। মোটের ওপর, এমন ডাগর চোখের মায়াবিনীকে পারতপক্ষে হারাতে চায় না সে। মাধবীকে চোখ নিয়ে চিন্তাভাবনা করতে বারণ করে কিছু পরামর্শ দিলো দীপন।

– মিস মাধবী, আপনি আমাদের হসপিটালে কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করাতে পারেন। চশমা ছাড়া দেখতে হলে প্রি-লেসিক করতে হবে। কোনো ভয় নেই আপনার। অতটা জটিল কোনো ব্যাপার নয়। কাল একবার হাসপাতালে আসুন। আপনার চোখ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে পরামর্শ দিতে পারবো।
– আচ্ছা লোকতো! মনে মনে ভাবলো মাধবী।
হাসপাতালে কেন আসতে বলছে! সে নিজেই তো ডাক্তার দেখাতে যেতে পারে।

দীপন একজন ডাক্তার সেকথা জানলেও সে নিজে ঢাকায় চেম্বার খুলেছে সেটা তখনও শুনেনি।

পরদিন হাসপাতালে যাওয়ার জন্য মাধবীকে তার বাড়ির সামনে থেকে এগিয়ে নিতে আসে দীপন।

হাসপাতালে যাওয়ার পর ডা. সাহেব চোখের কিছু পরীক্ষা করলেন। রিপোর্ট পরে দিবেন বলে আশ্বাস দিলেন। প্রায় সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছিল। তাই গোধূলি লগ্নে দীপন মাধবীকে একটুখানি চায়ের আহ্বান করলো। মাধবী আপত্তি করলো না এতে। বেশ কিছুক্ষণ আলাপ হলো একসাথে বসে। স্বল্প সময়ে যতটুকু করা যায় আর কী। দীপন বললো কিছুদিনের মধ্যেই সেমিনারে যোগ দেওয়ার জন্যে কানাডা ফিরে যেতে হবে তাকে। মাধবী যেন তাদের হাসপাতালে লেসিকটা সেরে নেয়। যদি কিনা চোখ লেসিকের জন্য উপযুক্ত থাকে।

মাধবী মনে মনে চাচ্ছিলো স্নাতকোত্তর শেষ করে বিয়েটা করতে। বিশেষত চোখটা সারিয়ে নেওয়ার ইচ্ছা ছিল প্রবল। দীপন বললো-

– ভেবেছিলাম পহেলা বৈশাখে আপনাকে নিয়ে মেলায় যাবো। কিন্তু সেমিনারটাই বাধ সাধলো।

মাধবীও এরকম কিছু একটা ভেবেছিল। একসাথে সময় কাটালে একে অপরকে জানতে আরো সুবিধা হবে। দু’জনের মনটা কিঞ্চিৎ খারাপ হলো। তবে এ আর এমন কী! বলে দু’জনেই হেসে উড়িয়ে দিলো।

দীপনের সাথে মাধবীর আংটিবদল হয়ে গেছে। সুন্দরী মেয়ে যদি আবার অন্য কারো প্রেমে পরে যায়। দীপনের মনের অবস্থা হয়তো কিছুটা আঁচ করতে পেরেছিল। তাই বলল, আপনার দেওয়া হাতের আংটির মর্যাদা আমি রাখবো। অভয় দিয়ে বললো মাধবী।

এরপর ডাক্তারবাবু দীপন চৌধুরী কানাডায় পাড়ি জমালেন। এক সপ্তাহ পরে রিপোর্ট এলো।
মাধবীর ড্রাই আই সিনড্রোম ছিলো। দীপন থাকলে তার তত্ত্বাবধানেই অবশ্য লেসিকটা হতো। এখন দীপন দেশে নেই তাই এটা সম্ভব হচ্ছে না। মাঝে মাঝে যোগাযোগ হতো তাদের।

– মাধবী….ই, মাধবী.. ই.. ই। কী ব্যাপার সে কখন থেকে ডাকছি! সাড়া দিচ্ছিস না যে?
– ওহ! মা তুমি? শুনতেই পাইনি।
– এত কী ভাবছিস? যা তৈরি হয়ে নে, বিকেল হয়ে যাচ্ছে তো
হঠাৎ মায়ের ডাকে সম্বিত ফিরে পেল যেন। সেই এক বছর আগেকার কথা ভাবছিল এতক্ষণ। সেই ডাক্তারবাবু দীপন চৌধুরীর কথা। ঠোঁটের কোণে অজান্তে এক চিলতে হাসি দেখা দিলো।

গোলাপী আর বেগুনী পাড়ের একটা বাসন্তী রঙের শাড়ি রাখা খাটের ওপর। সাথে রেশমি চুড়ি আর কাজল। আজ বাংলা নববর্ষ। কে যেন সকালে তার মায়ের কাছে দিয়ে গেছে এসব। শাড়ি পরে তাড়াতাড়ি তৈরি হতে তাগাদা দিচ্ছে মাধবীর মা। কী নাকি একটা সারপ্রাইজ আছে! বাড়ির বাইরে গেলেই বুঝতে পারবে এরকম কথা বললো।

মা কী ছেলেমানুষের মতো হেঁয়ালি করছে ভাবছে মাধবী।

ঝটপট শাড়িটা পরে বেরিয়ে গেল সে। মায়ের কী এমন সারপ্রাইজ তাও আবার বৈশাখের দিনে সেটা দেখতেই হবে।
লন ধরে হেঁটে এসে বাড়ির বাইরে এলো মাধবী।

সামনে আসতেই একটা কালো রঙের মার্সিডিজ বেঞ্জ চোখে পড়লো। গাড়ি থেকে নামছে এক সুদর্শন যুবক। চোখে নীলাভ রোদচশমা আর পরনে বেগুনী রঙের পাঞ্জাবী। যুবকটিকে দেখে মাধবীর চোখ যেন ঠিকরে বেরিয়ে আসবে। এতক্ষণে তার মায়ের গেটের কাছে যেতে বলার কারণ বুঝতে পারলো। এই তাহলে ছিল সেই আকাঙ্ক্ষিত সারপ্রাইজ।

– দীপনবাবু আপনি? কোন খোঁজ-খবর না দিয়ে!
– জি, তোমাকে চমকে দিবো বলেই আন্টিকে আমার কথা বলতে মানা করেছিলাম।
– কেমন সারপ্রাইজ দিলাম শুনি?
– একদম ধামাকা!

দু’জনেই হেসে উঠলো। জীবনে এরকম মুহূর্ত বারবার আসে না।

দীপন কেবল মাধবীকে দেখছে। বাসন্তী রঙের শাড়ি,হাতে রেশমি চুড়ি, গলায় হালকা গহনা,ভারী ঝুমকা আর খোঁপা করা চুলে একদম অপ্সরীর মত লাগছে মাধবীকে। কিন্তু মাধবীর চোখে এখনও চশমা।
দু’জনে গাড়িতে বসল। দীপন মনে মনে ভাবছে তবে কি মাধবী কন্ট্যাক্ট লেন্স ব্যবহার করছে না? সে কানাডা যাওয়ার পর লেসিক করেনি? হাজারটা প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছে মনে। মুখ ফুটে জিজ্ঞাসা করতে সংকোচ হচ্ছে।
মাধবী নিজ থেকে এ ব্যাপারে কিছু বলছে না। ফোনেও কোনো আলোচনা করেনি।

বৈশাখী মেলার কাছাকাছি পৌঁছে গেছে গাড়িটা। গাড়ি থেকে নেমে একটু হেঁটে যেতে হয়। ঘাসে ছাওয়া রাস্তার পাশ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে, রহস্যময় হাসি দিয়ে বলল মাধবী-

– এখনও চশমা পরছি কেন তাই ভাবছেন তো? চশমাটা খুলে ফেলে হেসে উঠলো মাধবী।

– আপনি একাই চমকে দিতে পারেন না মি. দীপন, আমিও পারি।
মা যখন গেটের কাছে যেতে বলেছিল তখনই মনে হয়েছিল এ নির্ঘাত ডাক্তারবাবু ছাড়া কেউ নয়। আমিও তো ইংরেজি শিক্ষিকা। কিছুটা আঁচ তো করতেই পারি,তাই না?
আমি এখন কন্ট্যাক্ট লেন্স পরি। লেসিকটা না হয় আপনার তত্ত্বাবধানেই করবো। হা! হা! হা!

দীপনও বেশ খুশি হলো। আর মাধবীর চোখের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বলে উঠলো-

“প্রহর শেষের আলোয় রাঙা সেদিন চৈত্রমাস
তোমার চোখে দেখেছিলাম আমার সর্বনাশ”

খানিকটা লজ্জা পেয়ে চোখ সরিয়ে নেয় মাধবী। কী যে বলেন না আপনি!

সত্যি কথা বলতে কী জানো মাধবীলতা? রবীন্দ্রনাথ ভুল কিছু বলে যাননি। আজ তোমার চোখ দেখে বুঝতে পারলাম। আসলেই এমন চোখে সর্বনাশ দেখতে কারো আপত্তি থকাার কথা নয়।

– মাধবী, একটা গান গাইবে?
– গান গাইবো আমি?
– হ্যাঁ, আন্টির কাছ থেকে শুনেছি তুমি খুব ভালো গান করো।
– মা বললো আর আপনিও….
– এখনও কি আপনি থেকে তুমি হতে পারে না?
– অনেক সময় আছে দীপন। পরে না হয়…
মনের অজান্তে কখন যে তুমি বলে ফেলেছে নিজেই জানে না মাধবী।
কোন গানটা গাইবে জানতে চাইলো মাধবী।

– তোমার যেটা ভালো লাগে গাও

মাধবী গান গাইতে শুরু করল-

“ভালোবাসি, ভালোবাসি
সেই সুরে কাছে দূরে,
জলে- স্থলে বাজায়
বাজায় বাঁশি”

1 COMMENT

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here