দেয়াল পত্রিকাই সাহিত্যের চারা

0
301
নওগাঁয় দেয়ালপত্রিকা উৎসবের একটি দেয়াল পত্রিকা।

১৯৮৫ থেকে ৯০ সালের কথা, তখন আমি হাইস্কুলে পড়ি, ১৯৯১ সালে এসএসসি পাশ করি। আমার স্কুলের নাম কামালপুর মো. হাশেম উচ্চ বিদ্যালয়। স্কুলটি নোয়াখালী জেলার চাটখিল উপজেলায় অবস্থিত।

আমাদের স্কুলের সিঁড়ির পাশে একটা নোটিশ বোর্ড ছিলো, তার পাশে আরেকটা খোলা বোর্ড ছিল। নোটিশ বোর্ড বাক্সের মতো সামনের অংশে নেট আর তালা লাগানো ছিল। অন্যটি নেট ছিল তবে তালা ছিল না। নিয়ম ছিল প্রতিমাসের শেষ রবিবারে ছাত্রছাত্রীরা ছোট ছোট গল্প, কবিতা, কৌতুক আর ছবি আঁকিয়ে এই বোর্ডে লাগাবে। লেখা বা ছবির নিচে নিজ নিজ নাম ক্লাস আর রোল থাকবে। পুরো সপ্তাহ সবাই দেখবে পড়বে। শিক্ষকরা দেখতেন, আমাদের ভালো মন্দ বলতেন, পরামর্শ দিতেন।

এটাকে কী বলতো তা মনে নেই, তবে এখন বুঝি এটাই ‘দেয়াল পত্রিকা’। এখন আর এটা করা হয় কিনা তাও জানি না। আসলে দেয়ালে হাতের লেখা পত্রিকা প্রকাশিত হয় বলে এটাকে দেয়াল পত্রিকা বলা হয়ে থাকে। সংক্ষেপে বলা হয় ‘দেয়ালিকা’। দেয়াল পত্রিকা অনেক আগে থেকে চর্চিত শিল্প মাধ্যম। দিনে দিনে এর ব্যাপ্তি বা ধরন-ধারণ পাল্টেছে। শিশু-কিশোরদের সৃজনশীল প্রতিভা বিকাশ, মুক্তবুদ্ধি ও সাহিত্য চর্চা, ভাবের আদান-প্রদান এবং মনোবিকাশের এক অনন্য মাধ্যম হল এই দেয়াল পত্রিকা।

আমরা জানি গাছ থেকে ফল পেতে হলে ছায়া পেতে হলে যেমন গাছ লাগাতে হয়, গাছের যত্ন নিতে হয়, তার সাথে সাথে সবার আগে একটা বীজ থেকে চারাগাছ করে লাগাতে হয়। সাহিত্যাঙ্গনে দেয়াল পত্রিকা হল সেই বীজ বা চারাগাছ। আমাদের দেশের অনেক খ্যাতিমান কবি-সাহিত্যিকদের অনেকের লেখালেখির হাতেখড়ি এই দেয়াল পত্রিকার মাধ্যমে।

যার সুন্দর অন্যতম এক উদাহরণ প্রিয় কবি সুকান্ত। “দেয়ালে দেয়ালে/মনের খেয়ালে/লিখে যাই কত কথা/আমি যে বেকার/পেয়েছি লেখার স্বাধীনতা…”। শিশু বয়সে কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য এভাবেই দেয়ালের ওপর কয়লার আঁচড় কেটে নিজের সৃজনশীল প্রতিভার প্রকাশ ঘটিয়েছিলেন। আর তা দেখে কমরেড মোজাফফর আহমেদ তার হাতে খাতা আর পেন্সিল তুলে দিয়ে বলেছিলেন, তার মনের কথাগুলো যেন খাতায় লিখে রাখে। এভাবেই শুরু করেছিলেন কবি সুকান্ত।

আমাদের দেশে দেয়াল পত্রিকা নতুন নয়, এর ইতিহাস অনেক পুরাতন। তবে কতদিনের পুরাতন তার দিন-ক্ষণ কোথাও উল্লেখ করা নেই। আমাদের ইতিহাসের অনেক ঘটনা যেমন হারিয়ে গেছে, তেমনি অনেক কিছুর রাজসাক্ষী এই দেয়াল পত্রিকা। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন, ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ ও স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন আমাদের জন্যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের এই সব আন্দোলনের সাথে দেয়াল পত্রিকার প্রতিবাদী ভূমিকার কথা অনেকেরই জানা। যা আমরা বড়দের মুখে শুনে থাকি। এককথায় দেয়াল পত্রিকা আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অন্যতম বিষয়।

আগেকার দিনে দেয়াল পত্রিকার প্রচলন ছিল সব জায়গায়, যেমন মফস্বলে, গ্রামে। প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে শুরু করে শহরের নামকরা বা অনেক বড় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। এমনকি ক্লাব, শিশু-কিশোর সংগঠন ও সাহিত্য-সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানেও।

একেক স্কুলে বা প্রতিষ্ঠানে একেক নিয়মে প্রকাশ করা হত দেয়াল পত্রিকা। মাসিক, ত্রৈমাসিক, ষান্মাসিক, বাৎসরিক বা ঋতুভিত্তিক দেয়াল পত্রিকা। শিশু-কিশোররাই হয় দেয়াল পত্রিকার সম্পাদক, প্রকাশক বা লেখক। তবে বড়রাও ছোটদের সাথে থাকতেন, ছোটদের গাইড করতেন, এখনও তাই করেন। বই আকারে বের বের হওয়া ম্যাগাজিনের সম্পাদকের ছাপার অংশটুকু বাদ দিয়ে যে কাজটুকু করতে হয়, দেয়াল পত্রিকার সম্পাদককেও সেইসব কাজ করতে হয়। বরং দেয়াল পত্রিকার সম্পাদককে অধিক সচেতন হতে হয় বানানের ক্ষেত্রে। কারণ এটা সবার চোখের সামনে খোলা থাকে। ছাপার ক্ষেত্রে বানান ঠিক করার অনেক সুযোগ থাকলেও দেয়াল পত্রিকায় পরে বানান ঠিক করার সুযোগ থাকে না। করলেও ঘষামাজা করতে হয়, যা সবার চোখে খারাপ লাগে।

দেয়াল পত্রিকার যেমন নির্দিষ্ট তারিখ নেই, তেমনি কোনো বিষয় নেই। তবে কোনো বিশেষ দিনকে সামনে রেখে করা হলে সে বিষয়েই সবাই লিখে থাকে। ছোটরা গল্প-কবিতা ও সৃজনশীল লেখা শিখে থাকে। শিক্ষার্থীরা নিজেদের দেখা চারপাশের বিষয়গুলোকে তুলে ধরার সুযোগ পায়। আমরা তো জানি সবার দেখার চোখ এক নয়, একই বিষয় কিন্তু ভাবনা আলাদা হয়, বলেই প্রকাশ তাদের আলাদা হয়। যা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী একে অপরের সঙ্গে ভাগাভাগি করতে পারে দেয়াল পত্রিকার সাহায্যে। নিজেদের প্রবন্ধ, কবিতা, অঙ্কন এবং অন্যান্য রচনা প্রকাশ করার সুযোগ পায় দেয়াল পত্রিকার মাধ্যমে।

প্রাচীন যুগ থেকে মুদ্রণ যন্ত্র, টাইপরাইটার এবং কম্পিউটার ব্যবহার শুরু হবার পূর্বে বিশ্বের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে হাতে লেখার এ নান্দনিক সাহিত্যপত্র বা হাতের লেখা পত্রের ব্যাপক প্রচলন ছিল। শুরুর ইতিহাস হারিয়ে গেলেও দেয়াল পত্রিকা তার জায়গা বজায় রেখেছে। একসময় বাংলাদেশের সব বিদ্যালয়ে ছিল দেয়াল পত্রিকার প্রচলন। মাসিক, বার্ষিক ও বিভিন্ন অনুষ্ঠান উপলক্ষে দেয়াল পত্রিকা বের করা হতো নিয়মিত। ঐতিহাসিক দিবস উপলক্ষেও দেয়াল পত্রিকা প্রকাশ ছিল অনেকটা অলিখিত নিয়ম। শুধু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নয়, সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোও প্রকাশ করত দেয়াল পত্রিকা।

দেয়াল পত্রিকাকে হারিয়ে যেতে দিবে না বলেই ২০০৮ সালে বাংলা একাডেমি চত্বরে প্রথম অনুষ্ঠিত হয় জাতীয় দেয়াল পত্রিকা উৎসব ও প্রতিযোগিতা। মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সহযোগিতায় মাত্র ৩০টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অংশগ্রহণে এ উৎসবের আয়োজন করা হয়। তবে দিন দিন এই প্রতিযোগিতার প্রতিযোগী বাড়ছে। নবম জাতীয় দেয়াল পত্রিকা উৎসব ও প্রতিযোগিতা হয় ২০১৫ সালের অক্টোবর মাসে সুফিয়া কামাল জাতীয় গণগ্রন্থাগার চত্বরে। মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের মুক্তবুদ্ধি চর্চার ক্ষেত্র আরও প্রসারিত করতে তিন দিনের এই উৎসব ও প্রতিযোগিতার আয়োজন করেছিল বাংলাদেশ দেয়াল পত্রিকা পরিষদ। প্রায় একশ স্কুলের শিক্ষার্থীরা এই প্রতিযোগিতায় অংশ নেন। এই উৎসব ও প্রতিযোগিতার উদ্বোধন করেন আমাদের সকলের প্রিয় কবি নির্মলেন্দু গুণ। আলোচক হিসেবে আরো উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ দেয়াল পত্রিকা পরিষদের সভাপতি ড. সিরাজুল ইসলাম।

দেয়াল পত্রিকা নিয়ে বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, “দেয়াল আমাদের কাছে যেমন একটি আশ্রয়স্থল ঠিক একইভাবে একটি বাধাও। স্কুল কলেজের অনেক নিয়মকানুন আমাদের ইচ্ছার বিকাশ হতে দেয় না। এসব নিষেধাজ্ঞা আর শাসন আমাদের সৃষ্টিশীলতাকে ধংস করে ফেলে। আর এ ধংসাত্মক বাধার দেওয়ালকে ভাঙার মাধ্যমই হচ্ছে দেয়াল পত্রিকা। আমাদের মধ্যকার বিচ্ছিন্নতা দূর করে একত্রিত হওয়া, সৃষ্টিকর্মের বিকাশ এবং আমাদের সংস্কৃতিকে রক্ষার জন্য দেয়াল পত্রিকা একটি কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে”।

ভাবের আদান-প্রদান, শিল্পভাবনার বিনিময়, বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা ও মনোবিকাশের মাধ্যম হিসেবে দেয়াল পত্রিকার জুড়ি নেই। খ্যাতিমান কবি-সাহিত্যিক বা লেখকদের অনেকেই হাতেখড়ি নিয়েছেন দেয়াল পত্রিকার মাধ্যমে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে জাতীয় দিবস ধরে দেয়াল পত্রিকা প্রকাশের রীতি বেশ পুরনো। অনেক সময় হাতের লেখার প্রয়োজনও হচ্ছে না। তাপরও দেয়াল পত্রিকা উৎসব হয়, প্রতিযোগিতা হয়, যৌথ প্রদর্শনী হয়। একসময় আমাদের যোগাযোগের মাধ্যমই ছিলো চিঠি লেখা, নিজের হাতে কাগজে কলমে চিঠি লিখে তা প্রিয়জনকে পাঠানো হতো। এখন মোবাইল ইন্টারনেট আমাদের চিঠিকে দুরে সরিয়ে দিয়েছে, এখন হাতের লেখার বিপরীতে টাইপিং লেখা, খুদেবার্তা, যা পড়ে স্বাদ মিটে না। কিন্তু আমাদের আশাবাদ হাতের লেখা চিঠির মতো দেয়াল পত্রিকা হারিয়ে যাবে না, বেঁচে থাকবে।

প্রযুক্তির সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে দেয়াল পত্রিকায় নানা পরিবর্তনও এসেছে। এক সময় তা তৈরি করা হয়েছে কাঠের তৈরি ফ্রেম আর কাগজ দিয়ে। এখন যুক্ত হচ্ছে নানা শিল্প মহিমা। বিশেষ করে পত্রিকার অবয়বকে আকর্ষণীয়, নান্দনিক এবং ঐতিহ্যময় করে তুলতে বর্তমান সময়ে কলাপাতা, পাটি, কুলা, চালনি, ডালা, চট, শোলা, শক্ত কাগজ, কাপড়, কাঁথা ব্যবহার হলেও এখন রঙ্গিন কাগজ, রংয়ের ব্যবহার হাতের কাজ ও যুক্ত করা হচ্ছে দেয়াল পত্রিকার সাথে।

দেয়াল পত্রিকার নির্দিষ্ট মাপ নেই এটি কখনও হালকা বোর্ডের ওপর লেখা হয়। কখনও মোটা কাগজের ওপর লিখে তা দেয়ালে সেঁটে দেওয়া হয়। দেয়ালে সেঁটে না দিলে দেয়াল পত্রিকা হবে না- এমনটি নয়। অনেক সময় সাদা মোটা কাগজে লিখে বোর্ডের ওপর সেঁটে দেওয়া হয়। দেয়াল পত্রিকা এখন আর শুধু দেয়ালে আবদ্ধ নেই। দেয়ালকে ছাপিয়ে তা চলে এসেছে দেয়ালহীন আঙিনায়, শ্রেণীকক্ষের বোর্ডে, স্কুল মাঠের খোলা প্রাঙ্গনে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here