ধুপছায়া দিন

0
481

বিকেলে বাজার থেকে বেরোনোর মুখে আটকে পড়ল উর্মি। ঝুম বৃষ্টি নেমেছে। লোকজন দৌড়াচ্ছে। ইতিউঁতি খুঁজছে মাথা বাঁচানোর ঠাঁই। উর্মিও সামান্য খালি জায়গা দেখে দাঁড়িয়ে পড়ল। আশ্বিন মাস চলছে। অথচ প্রকৃতির রূপ চির শ্রাবণের। এই বৃষ্টিতেও দুটি ছেলে মেয়ে ফুটপাত ধরে ধীর পায়ে হেঁটে চলে গেল। রাস্তার পানি ছিটিয়ে শোঁ শোঁ শব্দে বেরিয়ে গেল কয়েকটি গাড়ি। পাশের খালি জায়গায় ততক্ষণে ভীড় জমেছে। খেলনা কেনার বায়না ধরে তাঁর স্বরে চেঁচিয়ে কাঁদছে একটা বাচ্চা ছেলে। অল্প বয়স্ক মা, খুব চেষ্টা করছে তাকে থামাতে। বাচ্চাটি থামছে না।

উর্মির মনে পড়ল তিয়া, তুবান দু’জনই এই বয়সে বড্ড বাধ্য ছিল। কখনো বাইরে কোন কিছুর জন্য হৈচৈ করেনি, কান্নাকাটি তো দূরের কথা। তিয়া একটু আধটু ঠোঁট ফোলাতো। কিন্তু তুবান একদম চুপচাপ। খুব ইচ্ছে হলে কানে কানে বলত, ওই জিনিসটা তার পছন্দ, তাকে কিনে দেয়া যাবে কিনা। ছেলে মেয়ে দুটির কথা মনে হতেই উর্মির বুক চিরে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল। ভীষণ তাড়াতাড়ি বড় হয়ে গেল দু’জন।

তিয়া এবার মাস্টার্সে। তুবান ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে, সেকেন্ড ইয়ার। দু’জনের দুটো আলাদা জগৎ, আলাদা জীবন। দুই আলাদা শহরে তাদের বাস। ঈদ উপলক্ষে, কিংবা ছুটিতে তারা ঘরে ফেরে,কিন্তু সেই আগের তিয়া, তুবানকে আর পাওয়া যায়না। তাদের বাড়ি ফেরা মানে বন্ধু-বান্ধব নিয়ে হৈ-হুল্লোড়, গেট টুগেদার, বারবিকিউ পার্টি আরো কত কী! এইসব করতে করতেই ছুটি ফুরিয়ে যায়। তাদের সময় হয় না দু’দন্ড মায়ের পাশে বসে কথা বলার! অবশ্য তাদেরই বা দোষ দেই কিভাবে? যুগটাই তো এমন হয়ে গেছে।

বৃষ্টির বেগ বাড়ছিল। ছোট জায়গায় লোকজনের ভিড়ও বাড়ছে। এখন আর ভালোভাবে দাঁড়ানোরও উপায় নেই। সারি সারি দোকানগুলোর সামনে যেখানে দাঁড়িয়ে আছে সবাই, তার একটা এন্টিকসের শো রুম। যাবে নাকি একবার ভেতরে? বৃষ্টি থেকে গা বাঁচানোর পাশাপাশি একটু সময় কাটানোও হবে। একটু ভেবে ভারী কাচের দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে পড়ল উর্মি। সাথে সাথে প্রাচীনত্বের গন্ধ নাকে এসে লেগেছে। পুরানো যুগের কারুকার্যখচিত নানান জিনিস আর তৈজসপত্রে ঠাসা দোকান। ঘুরে ঘুরে দেখছিল সে। অন্দর দেয়ালে খুব সুন্দর নকশাকাটা এক জোড়া আয়না। উর্মি দাঁড়িয়ে পড়ল সেখানে। তখনই মস্তিষ্কে জোর ঝাঁকুনি। কাকে দেখা যায় ওই আয়নায়? ঝাপসা স্মৃতি ভেসে ওঠে চোখের তারায়। মুহূর্তের জন্য নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। সে কি সত্যি দেখছে নাকি ভ্রম? কোনো ভুল হচ্ছে না তো?

চকিতে পেছনে ঘুরল উর্মি। নাহ, ভ্রম নয়। ওই তো মানুষটা দাঁড়িয়ে আছে বড় শোকেসটার সামনে। সেই এক মুখ। প্রায় দুই যুগেও পরিবর্তন হয়নি। সেইরকমই ফরসা, একটু শুকিয়েছে বোধহয়। মাথায় কালো চুলের বদলে ইষৎ কাঁচাপাকা চুল, আগের মতোই পরিপাটি করে আঁচড়ানো, চোখে সাদা গ্লাস, ক্রিম রঙের শার্ট পরনে। দাঁড়ানোর ভঙ্গিটি পর্যন্ত আগের মতো। দূর অতীতের কথা মনে পড়ে গেল। প্রথমবার পরিচয়ের সময় ওইভাবেই তার সামনে দাঁড়িয়ে ছিল, তাই না?

প্রাথমিক ধাক্কা সামলে নিয়ে, ধাতস্থ হলো উর্মি। কিছুতেই মানুষটার চোখে পড়তে চায় না সে। অবশ্য এতদিন পরেও কি মনে আছে তাকে? থাক বা না থাক, তারই বা কী দরকার তাকে মনে রাখার! সন্তর্পণে মাথা ঘোরাতে যাবে উর্মি, ঠিক তখনই উড়ে এল পুরানো কণ্ঠস্বর
– উর্মি..

পলকের জন্য কেঁপে উঠল সে৷ কেন যে কাঁপলো? ঘুরে দাঁড়ালো উর্মি। হাসি মুখে মানুষটি এগিয়ে এল তার দিকে। বলল,
– আমি অমিত। চিনতে পারোনি,তাই না? অবশ্য সেই কত বছর আগে দেখেছিলে, এতদিনে ভুলে যাওয়া অস্বাভাবিক নয়।

“কতবছর আগে দেখেছিলে” কথাটা ঠক করে কানে গিয়ে বাজল তার৷ তাদের পরিচয়টা কি শুধু দেখা হওয়াতে সীমাবদ্ধ ছিল? আর কিছু ছিল না?

জোর করে মুখে হাসি ফোটালো উর্মি। বলল,
– আরে, তুমি এখানে? আসলে আমি খেয়াল করিনি, সরি। কী খবর?
– এই তো। ভালোই আছি। তুমি কিন্তু একদম আগের মতো আছ। বদলাওনি।

আলগা হাসল উর্মি। বলল,
– কী যে বলো! বয়স তো কম হলো না।
– কত? বত্রিশ না পঁয়ত্রিশ? এইটুকু বলে নিজের রসিকতায় নিজেই হাসলো অমিত ।
– যাকগে, তোমার তাড়া না থাকলে, একটু বসা যাক আগে, তারপর না হয় তোমার বয়সের হিসেব নেব।
– এই বৃষ্টিতে যাব কোথায়?
– উপরে একটা কফিশপ দেখেছিলাম, চল বসি। কোনো সমস্যা নেই তো?
– না! না! কিসের সমস্যা?
– ভাবলাম, আমার উপর হয়তো এখনো রাগ করে আছ?
– রাগ? তোমার সাথে রাগ করার মতো সম্পর্ক কখনো ছিল?
– তাহলে তো মিটেই গেল। বন্ধুর মতো একটু কথা তো বলতে পারি। এসো বসি..
– হ্যাঁ, চলো।

মুখে ‘সমস্যা নেই’ বলে অমিতের পিছু পিছু পা বাড়ালেও, মনে তখন উথাল-পাতাল চলছে উর্মির। এভাবে তার সাথে দেখা হয়ে যাবে স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি। অমিতের সাথে সম্পর্কের শেষ দিনগুলো কি আদৌ ভালো ছিল তাদের? রাগ, ঘৃণা ছিল না উর্মির? ছিল হয়ত, এখন আর মনে নেই৷ তবুও ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছিল তার। মুহূর্তে চোখের সামনে হাজির পুরোনো দিন, তাদের ৮৫ দিনের সংসার।

তাদের পরিচয় হয়েছিল উর্মির এক খালাতো বোনের বিয়েতে। মেজো খালা নিজে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। অবশ্য ঠিক তার সাথে অমিতের নয়। অমিতের মায়ের সাথে তার মায়ের। উর্মি তখন অনার্স ফাইনাল দিয়েছে৷ অমিতের পড়াশোনা শেষ। সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার অমিত নামি কোম্পানিতে চাকরিজীবী। বাবা মা বিয়ের জন্য পাত্রী খুঁজছেন। এদিকে উর্মির বাবা মাও মেয়ের বিয়ে দিতে চান। মেজখালা উদ্যোগ নিলেন, এই বিয়ে তিনি দিয়েই ছাড়বেন। দুই পরিবারের পরিচয়ের কয়েকদিনের মধ্যে অমিতের বাবা মা দেখতে এলো উর্মিকে। সাথে অবশ্য অমিত নিজেও এসেছিল। মেয়েরা ঠিক ঠিক যেমন ছেলেদের স্বামী হিসেবে ভাবতে পছন্দ করে, তাই ছিল অমিত। লাজুক, মুখচোরা উর্মির আড়চোখে একবার তাকে দেখেই ভালো লেগে গিয়েছিল। তখনকার দিনকাল, আজকের মতো ছিল না।

অমিত কিংবা উর্মি কেউ সুযোগ পেল না একবার একান্তে কথা বলার। পাত্রী দেখার দিন দুয়েক পর অমিতের বাড়ি থেকে জানানো হলো উর্মিকে তাদের পছন্দ। খুব তাড়াতাড়ি বিয়ে সেরে ফেলতে চান তারা। ছেলের বাবার ক্যান্সার ধরা পড়েছে। হাতে সময় নেই৷ নিজের পছন্দে ছেলের বিয়ে দেখে যেতে চান। মাত্র সাতদিনের মাথায় কোনোরকমে বিয়ে হয়ে গেল উর্মির।

ভাবতে ভাবতেই চলে এসেছে তারা। কাচের দেয়াল ঘেরা ছোট্ট ছিমছাম এক কফিশপ। সোমবারের বৃষ্টিমাখা বিকেল। সাজিয়ে রাখা টেবিলগুলোতে চলছে তুমুল আড্ডা। বেশিরভাগই অল্প বয়সী ছেলেমেয়ে। তাদের মতো মাঝ বয়সী দু’জনকে দেখে কয়েকজন ফিরে তাকালো। তারপর আবার ব্যস্ত হয়ে পড়ল গল্পে। একটা খালি টেবিলে মুখোমুখি বসে পড়ল অমিত আর উর্মি। ওয়েটারকে ডেকে দুটো কফির অর্ডার ছুড়ে দিয়ে বলল,

– তারপর বলো, কেমন আছ?
– এই তো। চলে যাচ্ছে। তোমার খবর কী? তুমি কি এখনো কানাডাতেই আছ?
– নাহ। এখন অস্ট্রেলিয়া।
– মানে ফ্যামিলি নিয়ে সেটেল্ড? কথাটা ইচ্ছে করেই বলল ঊর্মি। অমিতের সম্পর্কে জানতে ইচ্ছে হচ্ছিল বেশ।
– তা বলতে পারো। মাকেও নিয়ে গিয়েছি বছর পাঁচেক আগে।
– দেশে এলে কবে?
– এই তো মাসখানেক। ফেরার সময় চলে এল আবার। আসলে মায়ের জোরাজুরিতে আসা। ছোট মামা মারা গেলেন তো, মাকে ওখানে ধরে রাখা গেল না।
– ছোট মামা মানে? ওই যে নাটক করতেন ওই মামা, না?
– মনে আছে তোমার?

মনে ছিল না। তবু আজ হঠাৎ মনে চলে এল। অমিতের মামার সাথে উর্মির বেশ পরিচয় ছিল । অদ্ভুত ভালো কবিতা আবৃত্তি করতেন তিনি! থিয়েটার করতেন। বিয়ের দিন দশেক পর অমিতের সাথে থিয়েটারে তার রক্তকরবী দেখতে গিয়ে উর্মি মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিল। পর্দার আড়ালের রাজা তিনি ভরাট কণ্ঠে কাঁপন ধরিয়ে দিয়েছিলেন উর্মির মনে। কতদিন পর্যন্ত কথাগুলো কানে এসে বাজত,

“নন্দিন, একদিন দূরদেশে আমারই মতো একটা ক্লান্ত পাহাড় দেখেছিলুম। বাইরে থেকে বুঝতেই পারিনি তার সমস্ত পাথর ভিতরে ভিতরে ব্যথিয়ে উঠেছে। একদিন গভীর রাতে ভীষণ শব্দ শুনলুম, যেন কোন দৈত্যের দুঃস্বপ্ন গুমরে গুমরে হঠাৎ ভেঙে গেল। সকালে দেখি পাহাড়টা ভূমিকম্পের টানে মাটির নীচে তলিয়ে গেছে। শক্তির ভার নিজের অগোচরে কেমন করে নিজেকে পিষে ফেলে, সেই পাহাড়টাকে দেখে তাই বুঝেছিলুম। আর, তোমার মধ্যে একটা জিনিস দেখছি – সে এর উলটো।”

নাটক শেষে বাইরে বেরিয়ে উর্মি অমিতকে বলেছিল,
– কি চমৎকার দেখলে? হৃদয় জুড়িয়ে গেল। আর ছোট মামার তো জবাব নেই!

অমিত ফস করে একটা সিগারেট ধরিয়েছে। দিয়াশলাইয়ের কাঠিটা ছুড়ে ফেলতে ফেলতে বলল,
– কী যে সব পছন্দ তোমার! কিছুই বুঝি না! জাস্ট টাইম ওয়েস্ট! মামা এত করে ধরল বলে এলাম, না হলে কখনো আসতাম না।

অমিত আর উর্মির সেটাই শেষ একসাথে বেরোনোর ছিল। অবশ্য সম্পর্কটা নির্ধারণ হয়ে গিয়েছিল বিয়ের রাতেই। সেদিন সব আয়োজন শেষ করে অমিত ঘরে ঢুকে গম্ভীর গলায় বলেছিল,

– দেখো উর্মি, তোমাকে সবকিছু পরিস্কার ভাবে বলে নেয়া ভালো। তোমাকে আমি বিয়ে করেছি শুধুমাত্র বাবার কথা রাখতে। বাবা অসুস্থ। আমি চাই না, আমার জন্য উনার ভালোমন্দ কিছু একটা হয়ে যাক। আমি অন্য একজনের কাছে কমিটেড। তোমাকে কয়েকটা দিন একটু কষ্ট করে এখানে থাকতে হবে। তার মধ্যেই আমি সবকিছু ম্যানেজ করার চেষ্টা করছি।

নতুন বউ সেজে বসে থাকা উর্মি যেন সহসা লক্ষ ভোল্টের শক খেয়েছে৷ মুহূর্তে ভেঙে চুরমার হয়ে গেল হাজারো স্বপ্ন। কী সব বলছে অমিত? এ কেমন প্রহেলিকা? কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে সে জিজ্ঞাসা করেছিল,

– তাহলে আমাকে বিয়ে করলেন কেন? কথাবার্তা হওয়ার সময়ই তো না করে দিতে পারতেন। নিজের যাকে পছন্দ তার কথা জানাতে পারতেন।
– বাবাকে বোঝানোর চেষ্টা করেছিলাম, তিনি রাজি হননি। আসলে তিথি আমার থেকে দু’বছরের বড়। আমার বন্ধুর বড় বোন। বাবা কিছুতেই মানতে চাইলো না আর কী!
– আর সেজন্য আমাকে বিয়ে করে ফেললেন!

সাথে সাথে অমিতের অকপট উত্তর,
– সরি। আসলে আর কোনো উপায় ছিল। কয়েকটা দিন কষ্ট করুন প্লিজ।

কোনো প্রতিক্রিয়া ফুটল না উর্মির মুখে। কী বলবে সে? এমন ঘটনার জন্য সে আদৌ প্রস্তুত ছিল না। ফাঁকা দৃষ্টি বার কয়েক নড়েচড়ে বেড়ালো ঘরময়। সারারাত ঘুমোতে পারলো না সে। ততক্ষণে ঘরের অপরপাশে রাখা ডিভানে শুয়ে পড়েছে অমিত।
পরদিন সকালে সবাইকে সব কিছু জানিয়ে দিবে, এমনটাই ভেবেছিল উর্মি। কিন্তু হলো না। সকলের সামনে অমিতের হাবভাব দেখে মনে হলো, সে যেন বিয়ে করে খুব খুশী। আর উর্মির মতো স্ত্রী পেয়ে তো কথায় নেই। ছিঃ! কতটা অভিনয় জানতো! ভাগ্যিস এমন মানুষটার সাথে বেশিদিন থাকতে হয়নি।

ওয়েটার দুটো কফির কাপ রেখে গেল। তার একটা অমিত বাড়িয়ে দিল উর্মির দিকে। নিজের কাপে হালকা চুমুক দিয়ে বলল,
– তোমার হ্যাজবেন্ড বোধহয় কলেজের প্রফেসর?
– হুম, সরকারি কলেজে আছেন। ইংরেজির প্রফেসর।
– কী যেন নাম, ফাহাদ, তাইতো? শুনলাম খুব নামকরা শিক্ষক তিনি। আমার এক কাজিনের মেয়ে তোমার হাসবেন্ডের স্টুডেন্ট।

উর্মি মাথা নাড়ল, তারপর বলল,

– ফাহাদ শুধু ভালো শিক্ষক না, সে খুব ভালো স্বামী, সেই সাথে ভালো বাবা। এমন মানুষকে জীবনসঙ্গী হিসেবে পাওয়া গর্বের ব্যাপার।
– তা তো বটেই।

উর্মির মনে হলো অমিতের গলার স্বর সামান্য যেন কেঁপে উঠল। পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,
– আর তোমার দুটো ছেলে মেয়ে, না?

উর্মি একটু অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল। অমিত কি এখনো তার খোঁজ রাখে? কিন্তু কেন? কই এতগুলো বছরে উর্মি তো একবারো তার খোঁজ নেবার চেষ্টা করেনি! করবেই বা কেন? তাকে যে বিশ্রী অপমান নিয়ে চলে আসতে হয়েছিল, সে কথা ভুলবে কিভাবে? অপমানটা বহুদিন তুষের আগুন হয়ে জ্বলেছিল বুকের ভেতর। এতবছর পরে হয়ত বা আগুন নিভে গেছে, কিন্তু স্মৃতি আজও ঘায়ের মতো দগদগে। কেন যে এমন একটা ঘটনা ঘটলো তার সাথে! ক্রমশ অবসন্ন বোধ করছিল উর্মি। পুরানো দিনগুলো আবার যেন জ্যান্ত হয়ে উঠেছে।

অমিত তখন সম্মোহক এক পুরুষ। চমৎকার বাচন শৈলী, প্রাণখোলা হাসি, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের মতো সুরেলা ভরাট কণ্ঠস্বর। ঠিক যেন মেয়েদের স্বপ্নে দেখা রাজপুত্র। এমন একজন ছেলের প্রেমে না পড়ে উপায় আছে? উর্মি অমিতকে যত দেখতো, ততই মুগ্ধ হত। শুধু রাতগুলো ছিল বেমানান। ঘরের দরজা বন্ধ করার সাথে সাথে অমিত ব্যস্ত হয়ে পড়ত টেলিফোনে। দীর্ঘ রজনী চলত তার চাপা কণ্ঠে প্রেমালাপ। বিছানায় তখন কাঠ হয়ে পড়ে থাকতো উর্মি। তার ফিসফিসানি, চাপা হাসির দমক, যন্ত্রণা হয়ে ছড়িয়ে পড়ত হৃদয়ে। ইচ্ছে হতো অমিতকে জোর করে তার কাছে আটকে রাখার। চেষ্টা যে একবারে করেনি, তা না। কিন্তু পারলো কই?

বিয়ের মাত্র দেড় মাসের মাথায় অমিতের বাবা মারা গেলেন। আর শোক সন্তাপে ভাটা পড়ার সাথে সাথে অমিত সংসার থেকে তাকে ছাড়পত্র দেয়ার ব্যবস্থা শুরু করল। কী দুর্বিষহ দিন ছিল তখন এক একটা! নিজের পরিবার, আত্মীয় স্বজন, বন্ধু-বান্ধবকে কী বলবে উর্মি? কিভাবে মুখ দেখাবে? তার থেকেও বড় এত বড় একটা ধাক্কা খেয়ে বাঁচতে পারবে তো নিজে? মনে আছে প্রথম যেদিন বাবা মাকে জানালো, অমিত আর তার সাথে থাকছে না, বাবা মা হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল৷ একটু ধাতস্থ হতেই, অমিতকে দেখে নেবে বলে তড়পাচ্ছিল বাবা, মা মুখে আঁচল চাপা দিয়ে ক্রমাগত কাঁদছেন। উর্মির কী ভয়ঙ্কর স্নায়ুচাপ যে গেছে তখন!

মাসখানেক বিরতি দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে যাতায়াত শুরু করলো। সেখানেও এক অবস্থা। পরিচিত বন্ধুবান্ধব সবাই কেমন যেন হয়ে গেছে। তাদের আচরণে আরো বেশি কষ্ট হতো উর্মির। ভেতরে ভেতরে হাঁপিয়ে উঠেছিল সে। তারপর বছর ঘুরতেই আবার বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হলো। ছেলে বিসিএস ক্যাডার। সরকারি কলেজের শিক্ষক। ক্যাম্পাসের কোনো একটা অনুষ্ঠানে উর্মিকে দেখে, নিজেই বিয়ের প্রস্তাব পাঠিয়েছে। বাবা মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে না করতে পারল না উর্মি। কিন্তু অমিত কাঁটা হয়ে বিঁধে রইল বুকের ভেতর।

– কফি কিন্তু ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে। অমিতের কথায় যেন দূরদেশ থেকে ফিরে এলো উর্মি।
নিজেকে সামলে নিয়ে আলগা প্রশ্ন ছুড়লো,
– তিথি কেমন আছে? ওকে নিশ্চয় সঙ্গে করে নিয়ে এসেছ?
– না, ও আসেনি। ছেলের স্কুল আছে। ইচ্ছে করলেও আসার উপায় নেই৷ ওখানে এদেশের মতো হুটহাট স্কুল থেকে ছুটি নেয়া যায় না।
– তোমার কি একটাই ছেলে?
-হুঁ! ঘাড় নাড়ল অমিত।

উর্মি আর বলার মতো কথা খুঁজে পাচ্ছিল না। কফির কাপে শেষ চুমুক দিয়ে ভাবলো এবার উঠে পড়া যাক। ঠিক তখনই অমিত প্রশ্নটা করেছে,
– তুমি খুব সুখী হয়েছো তাই না উর্মি? চমৎকার স্বামী, সুন্দর ছেলে মেয়ে, এমনটায় হওয়ার কথা ছিল তোমার।

হঠাৎ এমন কথা শুনে থমকেছে উর্মি। চকিতে মনের পর্দায় ফাহাদের মুখ ভেসে উঠল। কর্তব্যপরায়ণ, নিষ্ঠাবান একজন মানুষ, সাথে আদর্শ স্বামী। যার প্রতি কখনো কোনো অভিযোগ করা যায় না। ছেলে-মেয়েরা মেধাবী, তাদের নিজ নিজ ক্ষেত্রে সফল। আত্মীয় স্বজনরা সবসময় তাদের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। এমন একটা জীবনই তো চাওয়া ছিল।
উর্মি হাসল। তারপর বলল,

– ঠিক বলেছ। মাঝে মাঝে মনে হয়, উই আর দ্য হ্যাপিয়েস্ট কাপল ইন দ্য ওয়ার্ল্ড। আর তুমিও নিশ্চয় তিথিকে নিয়ে খুব ভালো আছো?

অমিত মাথা নাড়ল। বলল,
– তা তো বটেই। আমরাও খুব ভালো আছি৷

বাইরে বৃষ্টি থেমে গেছে। স্বচ্ছ কাচে মেঘ ভাঙা শেষ বিকেলের আলো এসে পড়ছে। উর্মি উঠে পড়ল। বলল,
– সন্ধ্যে হয়ে এল। এবার ফিরতে হবে। আসি তাহলে?

অমিত মাথা নাড়ল। অস্ফুট স্বরে কী বলল ঠিক বোঝা গেল না। উর্মি পায়ে পায়ে নেমে এল বাইরে। ক্ষণিকের দেখা দেয়া সূর্য হারিয়ে গেছে পাটে।

আশ্বিনের ধুপছায়া দিন ফুরিয়ে আসছে দ্রুত। বহু বছর আগে, এমনই এক দিনে অমিতের সাথে তার সম্পর্কের সুতো ছিঁড়েছিল। মাঝে মাঝে মনে হয় বহু বছর নয়, এ যেন আরেক জন্মের কথা। কিন্তু আজও আলমারিতে পুরানো শাড়ির ভাজে কেন যত্ন করে উর্মি তুলে রেখেছে সেই পুরানো জীবনের স্মৃতি।

কেন আজও হৃদয়ের মাঝে মধ্যে উঁকি দিয়ে যায় তার পঁচাশি দিনের সংসার? অচেনা একটা হাওয়া চারিয়ে গেল উর্মির মনের ভেতর। শীত শীত করছিল তার। হঠাৎই।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here