নিশিরাতে মিসড কল

0
1287

অফিসের ডাইনিং রুমে দুপুরের লাঞ্চ করছিলেন শামীম সাহেব, এমন সময় পাশের চেয়ারে এসে বসলেন তারেক সাহেব। ভাতের ডিসটা নিজের দিকে টেনে নিয়ে প্লেটে ভাত তুলে নিতে নিতে তারেক সাহেব বললেন, ‘শামীম ভাই সাভার থেকে নারায়ণগঞ্জ আর কতদিন আসবেন?’
– দেখুন না ভাই, একটা বদলীর ব্যবস্থাই করতে পারছি না!
– সাভারে তো আপনার নিজের বাড়ি, আপনার স্ত্রী নিশ্চয়ই সারাদিন একাই থাকেন। রাত কয়টা সময় বাসায় পৌঁছাতে পারেন ইদানীং?

রুই মাছের পিঠ থেকে কাটা সরাতে সরাতে শামীম সাহেব বললেন, ‘ভাই সেই ভাগ্য কি আমার আছে? এই অফিসের ম্যানেজার আর হেড অফিসের এইচআরডি ইন-চার্জ সবাই শুধু অফিসের কাজটাই বুঝে, কারো জীবনযাপন নিয়ে তাদের কোনোই আগ্রহ নেই। পাঁচ বছর হয়ে যাচ্ছে, সাভার টু নারায়ণগঞ্জ যাতায়াত করছি। সবাই শুধু বলছে, এইতো আর কয়টা দিন; কিন্তু কয়টা দিন যে কবে শেষ হবে আল্লাহ্‌ ভালো জানেন।’

– কী করবেন ভাই? সবই কপালের লিখন! আমাদের জীবন যাদের হাতে, তারা শুধু নিজেদের সুখ-সুবিধাই ষোল-আনা বুঝে; কিন্তু অন্যেরটা একআনাও বুঝে না। আপনার বিষয়টা চিন্তা করলে মনটা খারাপ হয়ে যায়!
– ভাই শুনলাম নতুন মোবাইল নিয়েছেন?
– জি ভাই, নিলাম। আর কতদিন অফিস আর আত্মীয়-স্বজনের ফোন ব্যবহার করা যায়, তাই নিয়ে নিলাম।
– একটা কল দেন না, নাম্বারটা সেইভ করে রাখি। কখন আবার দরকার লেগে যায়।
– জি ভাই, কল দিচ্ছি। আপনার নাম্বারটা বলেন।
– জি আমার নাম্বার হলো, ০১৭……..
– ঠিক আছে, এইযে আপনার ফোনে রিং বাজছে। যে নাম্বারটা দেখা যাচ্ছে সেটাই আমার নাম্বার।
– আচ্ছা, সেইভ করে নেবো। আগে লাঞ্চটা শেষ করি।
– আচ্ছা ঠিক আছে, আমি কিন্তু আপনার নাম্বার সেইভ করে ফেলেছি।
– ধন্যবাদ। লাঞ্চ শেষ, আমি উঠে যাচ্ছি ভাই।

তারপর যথারীতি শামীম সাহেব খাবার টেবিল থেকে অফিসের ডেস্কে গেলেন আর ক্লায়েন্ট সামলাতে গিয়ে তারেক সাহেবের ফোন নাম্বারটা সেইভ করতে ভুলে গেলেন!

সাতটার দিকে অফিস ছুটি হলো, তারেক সাহেব শনি-আখড়া আর শামীম সাহেব সাভারের পথে রওনা হয়ে গেলেন। তারেক সাহেব রাত আটটার দিকে বাসায় পৌঁছালেও শামীম সাহেব বাসায় পৌছালেন রাত সাড়ে দশটায়।

শামীম সাহেব বিয়ে করেছেন ছয় বছর হল, মিসেসকে নিয়ে এক বছর ঢাকায় ছিলেন। তারপর মিসেসের বড়ভাইয়ের সাথে সাভারে একখণ্ড জায়গা কিনে সেখানেই একটা দোতলা বাড়ি করেছেন। বাড়িটা বানাতে নিজের জমানো টাকা, আত্মীয় স্বজনের কাছে ধার, ব্যাংকের লোন আরও কত কী যে করতে হয়েছে তার বিবরণ অনেক লম্বা। বাড়ি করার পর পাঁচ বছর যাবত মিসেসকে নিয়ে সাভারই থাকেন।

শামীম সাহেবের মিসেস দেখতে ফর্সা, সুন্দর গঠনের যাকে বলে আদর্শ বাঙালি রমণী। এদিকে শামীম সাহেব দেখতে কালো আর মোটেও আকর্ষণীয় না, যাকে বলে মাঝারি মানের চেহারা। শামীম সাহেবের ধারণা তার মিসেস সুন্দরী হওয়াতে আশেপাশের বাসা আর এলাকায় যুবক ছেলেরা সুযোগ পেলেই খাতির জমাতে চায়।

শামীম সাহেবের মানসিকতা তার মিসেস ভালো করেই জানেন। তাই নিজেকে একটু আড়াল করে রাখতেই পছন্দ করেন। শামীম সাহেবকে কিছুটা পেইন দেওয়ার সুযোগ পেলে তার মিসেস পেইন দেয়। আসলে শামীম সাহেবকে পেইন দেয়ার জন্যই তার মিসেস শপিং করতে গেলে কিংবা এলাকায় কারো সাথে দেখা হলে একটু খাতির জমানো ঢং করে নরম সুরে কথা বলে। এই নরম সুরে ঢং করে কথা বলা দেখেই শামীম সাহেব মনে মনে একটু ভয়ে থাকেন; কখন জানি তার মিসেস অন্যের হাত ধরে বাড়ী থেকে বের হয়ে যায়!

যাই হোক, শামীম সাহেব সেদিন রাতে বাসায় পৌঁছানোর পর রাতের খাবার শেষে ঘুমাতে যাবেন, এমন সময় তার মিসেস দেখেন শামীম সাহেবের মোবাইলে একটা মিসড কল। যেহেতু শামীম সাহেব প্রতিদিন মনে মনে তার মিসেসকে সন্দেহ করেন; সেহেতু তার মিসেস তাকে নিয়ে একটা সন্দেহের খেলা শুরু করার জন্য মোবাইলের মিসড কলটা দেখে বলে, ‘এতো রাতে তোমাকে ফোন দেয় কে? নিশ্চয়ই তোমার কলেজ লাইফের কোনো বান্ধবী? এসব মেয়েদের খেয়ে দেয়ে কোনো কাজ নেই; সুযোগ পেলেই পর পুরুষের সাথে প্রেমালাপ।’

শামীম সাহেব তার ফোনে আসা মিসড কল নাম্বারে (মানে দুপুরে লাঞ্চের সময় তারেক সাহেবের ফোন করা নাম্বারে) ফোন দিলেন। একটা দুইটা রিং বাজে কেউ ধরে না… কেউ ফোন ধরে না দেখে, রাগের মাথায় ফোন দিলেন তার মিসেসের দিকে। ফোন ছুড়ে দিয়ে বললেন, তুমি ফোন করে দেখো কে মিসড কল দিয়েছে?
এবার শামীম সাহেবের মিসেস ফোন দিলেন। একটা দুইটা রিং বাজে। বেজেই যাচ্ছে…

এদিকে তারেক সাহেব রাতের এশার নামাজ পড়ছিলেন, তাই ফোন ধরলেন তারেক সাহেবের মিসেস। ফোন ধরেই বললেন, শামীম ভাই কেমন আছেন। আপনি সাভারে রাত কটায় পোঁছালেন?
মেয়েলি কণ্ঠ শুনেতো শামীম সাহেবের মিসেস একটা সুযোগ পেয়ে গেলেন। কার সাথে কথা বলছেন, তা না জেনেই বললেন, ‘এই মেয়ে তুমি এতো রাতে আমার হাজব্যান্ডকে মিসড কল দিয়েছ কেন? আমার হাজব্যান্ড কখন সাভার এলো, কখন ঢাকা গেলো, কখন নারায়ণগঞ্জ গেলো এতে তোমার এতো আগ্রহ কেন?’

তারেক সাহেবের মোবাইলে যেহেতু শামীম সাহবের নাম্বারের সাথে তার নাম আর অফিসের নাম লিখে সেইভ করা আছে তাই তারেক সাহেবের মিসেস জেনেই ফোন ধরেছিল; কিন্তু এদিকে শামীম সাহেবের মিসেস সন্দেহ করার দুষ্টামি যখন বাস্তবে রুপ নিচ্ছে তখন শামীম সাহেবকে পেইন দেয়ার জন্য পরিস্থিতি আরও ঘোলাটে করে মজা পাচ্ছিল। সাধারণ দুষ্ট প্রকৃতির সুন্দরী মেয়েরা এই খেলাটা ভীষণ পছন্দ করে, আর ভালোভাবেই অভিনয় করে যেতে পারে!

শামীম সাহেবের মিসেস যেহেতু কথা না শুনেই আবোলতাবোল বলে যাচ্ছেন, এবার তারেক সাহেবের মিসেসও রেগে যান আর ফোন রেখে দেন।

নামাজ শেষ হলে, তারেক সাহেব বলেন, ‘কী ব্যাপার কার সাথে ফোনে কথা বললে? ’
তারেক সাহেবের মিসেস রেগে গিয়ে বলেন, ‘তোমার মোবাইলে শামীম (অফিস কলিগ) নামে যে নাম্বার আছে; সেই নাম্বার থেকেই ফোন এসেছিল, ভাবলাম তোমার কলিগ ফোন দিয়েছে। ফোন ধরে দেখি এক বিশ্রি স্বভাবের মেয়ে ফোন দিয়েছে। আমার কোনো কথা না শুনেই, আবোলতাবোল বলা শুরু করেছিল। আমি রাগ করে ফোন রেখে দিয়েছি।’

এবার তারেক সাহেব, তার মিসেসের মুখের দিকে তাকিয়ে ফোনটা হাতে নিলেন। নিয়ে দেখেন শামীম সাহেব ফোন দিয়েছিলেন। তিনি ভেবে পেলেন না, এতো রাতে কেন শামীম সাহেব ফোন দিবেন? সাভার যাবার রাস্তায় কোনো সমস্যা হয়নিতো? শামীম সাহেবের মিসেস কি বিশেষ কিছু বলতে চাইছিলেন, যেটা তার মিসেস বুঝতে পারেনি? সে সাতপাঁচ না ভেবে শামীম সাহেবকে ফোন দিলেন।

এদিকে শামীম সাহেবের মিসেস তো শামীম সাহেবকে পেয়ে বসেছেন। বললেন, তুমি আমাকে সন্দেহ করো? তুমি আমাকে আমার কাজিন আর আত্মীয়স্বজনের সাথেও কথা বলতে দাও না, এদিকে নিজে একটা মেয়ের সাথে রাত বিরাতে ফোনে কথা বল? আমি কথা বললে মহাভারত অশুদ্ধ; আর তুমি বললে সাত খুন মাফ? তোমার মতো এতো নিচু মন-মানসিকতার লোকের সাথে যে আমার বিয়েটা ঠিক করেছিলো, তাকে হাতের কাছে পেলে সবজি কাঁটার ছুরিটা আজ তার চোখে ঢুকিয়ে দিতাম, যাতে বাকী জীবন কোন সুন্দরী মেয়েকে চোখে দেখতে না পারে, আর বিয়ে দিয়ে সর্বনাশও করতে না পারে।

তারেক সাহেব ফোন দিচ্ছেন, একটার পর একটা রিং বাজছে। কেউ ফোন ধরে না।
শামীম সাহেব দেখলেন, সেই মিসড কল নাম্বার থেকে ফোন এসেছে। বউয়ের কথায় এমনিতেই মেজাজ গরম তার উপর রাত বাজে ১১.০০ টা। আগামীকাল সাড়ে ৫.০০ টায় ঘুম থেকে উঠে অফিসের জন্য রওনা হতে হবে। শরীরের রাগ আর ক্লান্তি মুখে নিয়ে ফোন ধরলেন।
– হ্যালো।
– ভাই আমি তারেক। শামীম ভাই আপনি এতো রাতে কেন ফোন দিয়েছিলেন?
– রাখ তোর তারেক। তোর ফোন থেকে আমার ফোনে রাত বিরাতে কোন মেয়েছেলে ফোন দিয়েছে? কেন দিয়েছে? সেটা আগে বল?
– ভাই, আপনিতো আজ দুপুরে আপনার নাম্বারটা দিয়েছেন। আমাকে চিনতে পারছেন না?
– আমি তোকে কেন চিনবো? তুই আমাকে চিনে রাখ, যদি তোর ফোন থেকে আমার ফোনে কোনো ফোন/মিসড কল আসে আল্লাহর কসম আমি তোকে কেটে দুইভাগ করে বুড়িগঙ্গায় ভাসিয়ে দেবো। এতে আমার জেল ফাঁসি যা হবার হবে।

তারেক সাহেব কিছুই বুঝাতে পারলেন না!? আর শামীম সাহেব ঠাণ্ডা মাথায় ভেবে দেখলেন না ফোনটা কার ছিল? যথারীতি ঝগড়া বেঁধে যাওয়ার মতো অবস্থায় ফোনটা কেটে দিলেন তারেক সাহেব।

সেই রাতে তারেক সাহেব তার মিসেসকে বোঝাতে পারলেন না, কেন শামীম সাহেব এমন করছেন!
অন্যদিকে, শামীম সাহেব তার মিসেসের কাছে কিভাবে নিজের চরিত্রটাকে আরও পরিষ্কারভাবে উপস্থাপন করা যায়; সেটা ভাবতে ভাবতে আতংক নিয়ে ঘুমাতে গেলেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here