ফের মালিকানা বিতর্কে ‘মাসুদ রানা’

0
459

নতুন করে আলোচনায় এসেছে সেবা প্রকাশনীর জনপ্রিয় গোয়েন্দা সিরিজ ‘মাসুদ রানা’। গত বছরে মাসুদ রানার লেখক দাবি করে স্বত্ব চেয়ে কপিরাইট অফিসে মামলা করেছিলেন দুজন ঘোস্ট রাইটার শেখ আবদুল হাকিম ও ইফতেখার আমিন। গত রোববার কপিরাইট অফিসের মামলার রায়ে বলা হয়েছে ২৬০টি মাসুদ রানা সিরিজ ও ৫০টি কুয়াশা সিরিজের লেখক শেখ আবদুল হাকিম। ইফতেখার আমিনের বিষয়টি মীমাংসা হবে আরো কিছুদিন পরে।

কপিরাইট অফিসের রায়ে মাসুদ রানার লেখক হিসেবে শেখ আবদুল হাকিমকে স্বীকৃতি দেওয়ায় ঝড় উঠেছে নেট দুনিয়ায়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক ব্যবহারকারীরা পক্ষে-বিপক্ষে নানা মন্তব্য করছেন। দুর্নীতি ও অসততার তীর ছুঁড়ছেন কাজী আনোয়ার হোসেনের দিকে। কেউ কেউ নিজেদের ‘হতবাক’ হওয়া মনোভাব প্রকাশ করেছেন। আবার আরেকটি পক্ষ লেখক-প্রকাশক কাজী আনোয়ার হোসেন ও ঘোস্ট রাইটার শেখ আবদুল হাকিমকেও সমানভাবে অভিযুক্ত করছেন। তারা যুক্তি দেখাচ্ছেন, বিদেশি বইয়ের ছায়া অবলম্বনে মাসুদ রানা রচিত হলেও মূল লেখক ও প্রকাশকের অনুমতি নেওয়া হয়েছে কিনা। এর আইনগত ভিত্তি না থাকলে উভয়ের বিরুদ্ধেই ‘চৌর্যবৃত্তি’র অভিযোগ আনা যায়।

২০১০ সালে প্রথম শেখ আবদুল হাকিম মাসুদ রানা ও কুয়াশা সিরিজের সিংহভাগ বইয়ের লেখক দাবি করে কপিরাইট অফিসে অভিযোগ দেন। দীর্ঘ ৯ বছর তার শুনানি না হওয়ায় ২০১৯ সালের ২৯ জুলাই শেখ আবদুল হাকিম মাসুদ রানা সিরিজের ২৬০টি ও কুয়াশা সিরিজের ৫০টি বইয়ের লেখক হিসেবে স্বত্ব দাবি করে আবেদন করেন ফের। সেবা প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী কাজী আনোয়ার হোসেনের বিরুদ্ধে কপিরাইট আইনের ৭১ ও ৮৯ ধারা লঙ্ঘনের অভিযোগ তোলেন তিনি।

কপিরাইট অফিসের রায় দেওয়ার আগে কয়েকজন লেখক, প্রকাশক ও সেবা প্রকাশনীর সাবেক ব্যবস্থাপকের লিখিত মতামত চাওয়া হয়। সংশ্লিষ্টরা হলেন- লেখক বুলবুল চৌধুরী, শওকত হোসেন, শিল্পী হাশেম খান ও সেবা প্রকাশনীর ব্যবস্থাপক ইসরাইল হোসেন খান। তাদের লিখিত মতামতের ওপর ভিত্তি করে রায় দেওয়া হয়। রায়ের বিষয়ে ব্যাখ্যা দেন কপিরাইট অফিসের রেজিস্ট্রার জাফর রাজা চৌধুরী- মাসুদ রানা সিরিজের ১ থেকে ১৮ নম্বর সিরিজ পর্যন্ত কাজী আনোয়ার হোসেন লিখেছেন। এরপর থেকে শেখ আবদুল হাকিম লিখতে শুরু করেন। তিনি মূল পাণ্ডুলিপি লিখতেন এবং কাজী আনোয়ার হোসেন সেটি সম্পাদনা করতেন। ফলে আইন অনুযায়ী মূল পাণ্ডুলিপি লেখকই মূল লেখক। কাজী আনোয়ার হোসেন এ ক্ষেত্রে বড়জোর সম্পাদক। লেখার জন্য শেখ আবদুল হাকিম খুব সামান্য সম্মানী পেয়েছেন বলেও শুনানিতে উল্লেখ করা হয়।

জাফর রাজা চৌধুরী বলেন, কাজী আনোয়ার হোসেন চাইলে এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল আবেদন করতে পারবেন। আইন অনুযায়ী ৯০ দিনের মধ্যে আবেদন করতে হবে। এখানেও হেরে গেলে তিনি হাইকোর্টে আপিল করতে পারবেন। মাসুদ রানা সিরিজের আরও ৫০টি বইয়ের লেখক দাবি করে আর একজন লেখক ইফতেখার আমিনের ওপর শুনানি শিগগির শুরু হবে।
রায়ের প্রতিক্রিয়ায় ফেসবুকে নিজের টাইমলাইনে শেখ আবদুল হাকিম লেখেন, ‘রায় পেলাম। খুব আনন্দ হচ্ছে। আমি সারাজীবন ধরে সেবা প্রকাশনীতে যা কিছু লিখেছি, এটা তার স্বীকৃতি। এতে আমার একটা যুদ্ধ সাফল্যের সঙ্গে শেষ হলো; এবার দ্বিতীয় যুদ্ধ শুরু হবে। আমাকে আমার ন্যায্য পাওনা পেতে হবে। আমাকে বিনয়ী হতে দিন।’

অন্যদিকে আরেকজন লেখক ইফতেখার আমিন স্ট্যাটাস দেন কাজী আনোয়ার হোসেনকে ইঙ্গিত করে। তিনি লেখেন- ‘যে পরিণতি জেনেও সতর্ক হয় না, তার মানসম্মান কে বাঁচাবে?’ এ দুই লেখকের টাইমলাইনে সরাসরি পোস্ট এবং স্ট্যাটাস ট্যাগ করেন তাদের অনুরাগীরা। অভিনন্দন জানানোর পাশাপাশি ‘ন্যায্য পাওনা’ বুঝে নেওয়ার বিষয়ে তাগিদ দেন তারা।

এদিকে কাজী আনোয়ার হোসেনের পক্ষে তার পুত্রবধূ মাসুমা মায়মুর সেবা প্রকাশনীর অফিসিয়াল ফ্যান পেজে এবং নিজের টাইমলাইনে অবস্থান তুলে ধরেন। তিনি লিখেছেন- ‘সম্মানিত সেবার পাঠক, আমি আপনাদের আগেও জানিয়েছিলাম রায়ের কপি আমরা হাতে পাইনি। আমরা রায়ের কপি হাতে পাওয়ার জন্য কপিরাইট অফিস বরাবর আবেদন করেছি। রায় সম্পর্কে আমাদের বক্তব্য জানার জন্য অনেক গণমাধ্যম (পত্রিকা ও টিভি) আমাদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ করছেন। কিছু প্রশ্নের জবাবও আমরা দিয়েছি। সময়ের অভাবে অনেকের প্রশ্নের জবার দিতেও পারিনি। তাদের কাছে আন্তরিকভাবে দুঃখিত। সেবা প্রকাশনী এই মর্মে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, রায়ের কপি হাতে না পাওয়া পর্যন্ত গণমাধ্যমে কোনও প্রকার বক্তব্য দেবে না। রায়ের কপি হাতে পেয়ে আমরা সেবা প্রকাশনীর অফিসিয়াল পেজে পরবর্তী সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেব।’

কপিরাইট অফিসের রায়ের বিষয়টি ফেসবুকে ভাইরাল হলে স্ট্যাটাস দেন অনেকেই। তাদের মধ্যে সেবা প্রকাশনীর সহযোগী প্রকাশনা রহস্যপত্রিকার লেখক ও প্রচ্ছদ শিল্পী রাজীব চৌধুরী সমালোচনার পাল্টা জবাব দিয়ে লিখেছেন, ‘চল্লিশ টাকা দামের পাইরেটেড উইন্ডোজ সিডি কিনে কম্পিউটার চালানো পাবলিকও সেবা প্রকাশনীকে চোর ডাকতেসে! অদ্ভোত!’

লেখক ও সাংবাদিক মাহবুব মোর্শেদ লিখেছেন- ‘খুব জরুরি প্রশ্ন তুলেছেন মারুফ ভাই। কবি মারুফ রায়হান। সেবা প্রকাশনীর প্রায় সব বই-ই তো বিদেশি কোনো না কোনো বইয়ের ছায়া অবলম্বনে লেখা। কপিরাইট আসলে কার অনুকূলে যাবে? মূল বইয়ের অনুকূলে নাকি বাংলা এডাপ্টেশনের অনুকূলে। সেবা প্রকাশনী যদি মূল লেখকদের অনুমতি নিয়ে এডাপ্ট করতো তাহলে তাদের কাছে বৈধ কাগজপত্র থাকতো। কিন্তু তা তাদের নাই, বোঝা যায়। থাকলে শেখ আবদুল হাকিমের ক্লেইম দুর্বল হয়ে যেতো। তখন কপিরাইট সেবার নামে থাকতো। শেখ আবদুল হাকিম শুধু এডাপ্টেশনের কপিরাইট ক্লেইম করতে পারতেন। মাসুদ রানা নিজে জেমস বন্ডের নকল। বইগুলো নানা বইয়ের নকল বা ছায়া অবলম্বনে লেখা। ওপর এডাপ্টেশন যারা করেছেন তাদের ক্রেডিট না দিয়ে ক্রেডিট নিয়েছেন কাজী আনোয়ার হোসেন। আবার এডাপ্টেশনের লেখকদের সম্মানী ও মজুরি ঠিকমতো দেননি। সেই মাসুদ রানা আবার আমাদের জাতীয় কল্পচরিত্র। গত শতাব্দীর বাংলাদেশের ইতিহাসে মাসুদ রানা সবচেয়ে বড় জালিয়াতি।’

ক্রীড়া সাংবাদিক ও লেখক দেবব্রত মুখোপাধ্যায় তার টাইমলাইনে লিখেছেন- ‘মাসুদ রানা একটা ব্র্যান্ড; এই ব্র্যান্ড কাজী আনোয়ার হোসেনের সৃষ্টি ও সম্পদ। এটা না বুঝে শেখ আবদুল হাকিম নিশ্চয়ই বছরের পর বছর তার সাথে কাজ করেননি। আজ বইয়ে নাম যাচ্ছে না, কাল যাবে; এমন মেকি আশাতেও তিনি নিশ্চয়ই ৩১০টা বই লিখে ফেলেননি? তাহলে সমস্যাটা কোথায় হলো? এই বছর কয়েক কেন হঠাৎ আবদুল হাকিম নিজের নাম পেতে এরকম মামলা, সালিশির দ্বারস্থ হলেন? এর পেছনে অন্য গল্প আছে; আমি যতদূর বুঝি অনেক বড় অপমান আর বঞ্চনার গল্প আছে। যারা আবদুল হাকিম বা কাজী আনোয়ার হোসেনের পক্ষ নিচ্ছেন; তারা চেষ্টা করেন, গল্পটা জানার ও বোঝার। স্রেফ কিছু মাসুদ রানা পড়ার ভক্তি দিয়ে এসব বুঝতে পারবেন না। এই ফেসবুকেই আমার ফ্রেন্ড লিস্টে অন্তত জনা পাঁচেক লোক আছেন, যারা এসব গল্প জানেন। তারাই কেবল চুপ করে আছেন। চুপ করে থাকাই জ্ঞানীর লক্ষণ। আর একটা কথা বলি, পারিবারিক উত্তরাধিকার খুব খারাপ জিনিস।’

পারিবারিক উত্তরাধিকার বলতে তিনি হয়তো কাজী আনোয়ার হোসেনের দুই পুত্রসন্তানকেই বুঝিয়েছেন। ভক্ত-পাঠকরা তাকে ভালোবেসে ডাকেন কাজীদা। এই নামেও সমধিক পরিচিত তিনি। কাজী আনোয়ার হোসেন অদ্যাবধি বাংলা একাডেমির পুরস্কার না পাওয়ায় আবেগঘন স্ট্যাটাস দিয়েছেন জনপ্রিয় লেখক সুমন্ত আসলাম। তিনি লেখেন, ‘…কাজী আনোয়ার হোসেন কি কোনো পুরস্কার পাওয়ার যোগ্য নন? আমি জোর গলায় বলতে পারি, চিৎকার করে বলতে পারি- বাংলা একাডেমি থেকে এ পর্যন্ত যারা পুরস্কার পেয়েছেন, তার অর্ধেক লেখক কাজীদার ছাত্র হওয়ার যোগ্য নন, তার সমতুল্য লেখালেখি তো দূরের কথা!’

অন্যদিকে বিপরীত মনোভাব ব্যক্ত করেছেন লেখক ও উন্নয়নকর্মী মোজাম্মেল হক নিয়োগী- ‘দু’বছর আগে থেকে অনেকেই কানাঘুষা করেছিলেন যাতে কাজী আনোয়ার হোসেনকে বাংলা একাডেমির পুরস্কার দেওয়া হয়। না দেওয়াতে উভয়ের ইজ্জত রইল।’

লেখক ও প্রকাশক অস্ট্রিক আর্যু লিখেছেন- ‘মাসুদ রানা একটা শক্তিশালী প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান থেকে নতুনভাবে প্রকাশের উদ্যোগ চলছে।’ আরও কেউ কেউ এমন মন্তব্য করেছেন। কানাঘুষা রয়েছে, বড় এ প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানটির পেছনে রয়েছে প্রথম সারির একটি দৈনিক পত্রিকা। মূলত তারাই শেখ আবদুল হাকিমকে দিয়ে এসব করাচ্ছেন বলে অভিযোগ চাউর হচ্ছে। লেখক-প্রকাশকের শ্রদ্ধা ও সম্মানের সম্পর্কে চিড় ধরাচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। এসব ফিসফাসের মধ্যেই ‘আবির্ভাব’ ঘটেছে আরেকটি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের। গত ১৫ তারিখে সালমা বুক ডিপো’র ফেসবুক পেজ থেকে ঘোষণা দেওয়া হয়- “সালমা বুক ডিপো’র বইয়ের তালিকায় নতুন যুক্ত হলো মাসুদ রানা সিরিজ এবং কুয়াশা সিরিজ”। ঘোষণার সাথে একটি বেসরকারি টেলিভিশনে প্রচারিত সংবাদ ভিডিওর লিংকও জুড়ে দেওয়া হয়।

সাংবাদিক হাসান মামুন স্ট্যাটাসে লেখেন- ‘মাসুদ রানা একটি প্রকল্পের নাম, যা ক্লিক করেছিল। এতে কোনো লেখক নেই। আছেন উদ্যোক্তা, সম্পাদক-প্রকাশক এবং তার সঙ্গে চুক্তিতে কাজ করা একগুচ্ছ অনুবাদক। অনেক দেরিতে দ্বিতীয় পক্ষের ক্ষুব্ধ একজন এ নিয়ে মোকদ্দমায় গিয়ে খুব প্রাথমিক নিষ্পত্তি পেয়েছেন। তাতে বোঝা যায়, প্রকল্পে কিছু অপরিচ্ছন্নতা ছিল। আমাদের অনেক সাফল্যের পেছনেই আছে অপরিচ্ছন্নতা, এমনকি ক্রাইম। সেটা জেনেও অনেকে চুপচাপ থাকি। আর যারা পরে জানে, তারা কষ্ট পায়। মাসুদ রানা পড়ে যে আনন্দ মিলেছিল, সেটা অবশ্য খাঁটি। অনেকের পাঠের অভ্যাস মজবুত হয়েছিল, সে-ও সামান্য নয়।’

সাব্বির জাদিদ লিখেছেন, ‘…যারা ভাবছেন, শেখ আবদুল হাকিম বইগুলো নিজের নামে প্রকাশ করেও তো অর্থোপার্জন করতে পারতেন, তারা ভুল ভাবছেন। মাসুদ রানার বাইরে শেখ আব্দুল হাকিমের স্বনামে অনেক বই আছে। প্রথম আলো ঘটা করে ঈদসংখ্যায় তার থ্রিলার ছাপে। কিন্তু সেগুলোর একটাও মাসুদ রানার মতো পাঠকপ্রিয় হয় না। এর কারণ- কাজী আনোয়ার হোসেনের ব্র্যান্ডিং আছে, আবদুল হাকিমের নেই। বহু বছর আগে হাকিম সাহেব কাজীদার ওই নামের ব্যান্ডিংয়ের নিচে নিজেকে সমর্পণ করেছিলেন।’

কবি ও প্রচ্ছদ শিল্পী নির্ঝর নৈঃশব্দ্য লিখেছেন, ‘…মাসুদ রানা যখন শুরু হয় তখন হাকিম সাহেবের জন্মই হয় নাই। ধ্বংস পাহাড়ের প্রায় ২০ বছর পরে তার জন্ম। আর তিনি মাসুদ রানা লেখার লায়েক হয়েছেন কত বছর বয়সে সেইটা আপনারা ভাইবা নেন। এইসব বিনোদনমূলক ভেজাল বইয়ের অথরশিপ নিয়ে যে হাঙ্গামা শুরু হয়েছে তা খুবই লজ্জাজনক। যার লেখালেখির অভ্যাস আছে এমন যে কাউকে দিলেই প্রতি মাসে একটা করে এমন বই বিদেশি বই ভেঙে সে নামাতে পারবে। প্রাইমারি কাঠামো আর চরিত্র তো সব ঠিক কাজী সাহেবেরই বানানো।’

অণুগল্প লেখক-গবেষক বিলাল হোসেন লিখেছেন, ‘মাসুদ রানা সিরিজের লেখক হিসেবে কাজী আনোয়ার হোসেনকেই চিনি-জানি। আজ শুননাম সেবার আরেকজন লেখক আবদুল হাকিম মাসুদ রানার প্রকৃত লেখক হিসেবে দাবি করেছেন। সবাই তাকে কংগ্র্যাচুলেশন দিচ্ছেন। আমার মনে হচ্ছে, এতদিন পর এইসব দাবি করা ঠিক না। টাকার বিনিময়ে একসময়ে লেখা বেচেছেন। সংসার চালাইছেন। মিষ্টি জর্দা দিয়া পান চিবাইছেন। আজ সেই দাঁত নাই, পানও নাই। তাই মনে পড়ছে- বইগুলা তার লেখা। সবচেয়ে বড় বিষয়, লেখাগুলি মৌলিক হতো একটা কথা ছিলো। বিদেশি বইয়ের কাটপিস লেখা বই- তারইবা কী করে হয়! এইসব আবর্জনার মালিক হতে চাওয়ার ইচ্ছাটা আসে কোত্থেকে?’

নানান আলোচনা সমালোচনার বিপরীতে সেবা প্রকাশনীর পক্ষে লেখক ও নাট্যকার মাসুমা মায়মুর নিজেদের অবস্থান জানিয়েছেন। পৃথক আরেক স্ট্যাটাসে তিনি লেখেন- ‘আমরা এখনও রায়ের কপি হাতে পাইনি। পত্রিকার ভাষ্যমতে কয়েকজনের লিখিত সাক্ষ্যের ভিত্তিতে ২৬০টি মাসুদ রানার কপিরাইট (শেখ আবদুল হাকিম নির্ধারিত টাকা জমা দিয়ে আবেদন করলে) শেখ আবদুল হাকিমকে দেওয়ার কথা হয়েছে। এখানে অনেকের মনে অনেক প্রশ্ন জেগেছে। কিন্তু আইন জানতে হবে না। জাস্ট যুক্তি দিয়ে ভেবে দেখলে কিছু বিষয় আমাদের সামনে এসেছে।

১. লিখিত বক্তব্যের ভিত্তিতে রায় দেওয়া কতটা যুক্তিযুক্ত বা আইনসম্মত যেখানে অপরপক্ষকে সেই বক্তব্যকে চ্যালেঞ্জের সুযোগ না দেওয়া হয়?
২. যদি সরাসরি সাক্ষ্য নেওয়া হয় আমাদের উকিলকে সেই সাক্ষীকে জেরা করার সুযোগ না দেওয়া কীসের ইঙ্গিত বহন করছে?
৩. যদি এখন কেউ বলে থাকেন যে আমাদের জানানো হয়েছিল- কিন্তু কীভাবে? আমরা সরকারি ডাক বিভাগের মাধ্যমে কোনো চিঠি পাইনি। এই ক্ষেত্রে রেজিস্ট্রি চিঠি দেওয়া হয় আর সেটা আমাদের সই করে রাখতে হবে। কেউ কি প্রমাণ দিতে পারবেন যে আমরা কোনো চিঠি পেয়েছি? আর আমাদের না জানিয়ে এক পাক্ষিক সাক্ষ্য নেওয়ার ব্যাপারে আইন কী বলে?
৪. একটা প্রশ্ন আসছে যে শেখ আবদুল হাকিমকে তার ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। উনি সই করে কোন বইয়ের জন্য কত টাকা নিয়েছেন সেটা আদালতে আমরা উপস্থাপন করব। সেই ডকুমেন্টস আমাদের কাছে আছে, ওনার সইসহ। (একজন মানুষ দীর্ঘ ৪০ বছর ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত হয়ে লিখে গেছেন। ওনাকে আমরা কিডন্যাপ করেছিলাম এই কথাটাও কেউ বলে বসবে নাকি কে জানে)!
৫. উনি ঘোস্ট রাইটার ছিলেন আর ঘোস্ট রাইটার মানে কী সেটা অনেকেই জানেন না। দয়া করে নিজ দায়িত্বে জেনে নিন।
৬. জাজের কাছে যে তিনটি মাসুদ রানা বিক্রি করা হয়েছে সেটার টাকা শেখ আবদুল হাকিম পাবেন কিনা সেটা নিয়েও প্রশ্ন। জবাব হচ্ছে ওই তিনটি বই কাজী আনোয়ার হোসেনের মৌলিক লেখা। আর মৌলিক লেখা না হলেও কোম্পানির লাভ লসের সাথে ঘোস্ট রাইটারদের কোনো সম্পর্ক নেই। কোম্পানি সেই লেনদেন জাজের সাথে করুক বা মেজাজের সাথেই করুক।’
বিদ্যমান পরিস্থিতিতে সংবাদমাধ্যমে ভাষ্য দিয়েছেন বাদী-বিবাদী উভয়েই। শেখ আবদুল হাকিম বলেন, ‘একটা বইয়ের পাণ্ডুলিপি জমা দিলে ১০ হাজার টাকা আমাকে দিতেন কাজী সাহেব। এক মাস পর যখন বইটা বের হতো, তখন আরও কিছু টাকা পেতাম। পরে ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে রয়্যালিটি দিতেন। কিন্তু গোলমাল লাগছে, আমার বই তারা ছাপছেন, সেটা কিন্তু খাতায় তুলছেন না। এটা তো সিরিয়াস একটা সমস্যা। একটা বই তারা ছাপলেন ৬০ হাজার কপি। কিন্তু আমাকে দেখাচ্ছেন সাত হাজার। আমি তো ৫৩ হাজার বইয়ের পয়সা পাচ্ছি না।’

অভিযোগ খণ্ডন করে ‘মাসুদ রানা’র জনক কাজী আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘শেখ আবদুল হাকিমের সঙ্গে লিখিত চুক্তি করার প্রয়োজন কখনো আমি মনে করিনি। শেখ আবদুল হাকিম অনেক ছোট বয়সে আমার কাছে এসেছিলেন। আমি তাকে অনেক স্নেহ করতাম। পরে লক্ষ করলাম, উনি আস্তে আস্তে অন্যরকম হয়ে গেলেন। হাতে ধরে ধরে অনেক কিছু শিখিয়েছি। সেই লোক এই কাজ করবেন, এটা আমি কল্পনাও করতে পারিনি। এটা আমার কল্পনার বাইরে ছিল। কেউ যদি ডিফেম করে, তাহলে আমি তো ঠেকাতে পারব না। ইফতেখার আমিন ও শেখ আবদুল হাকিম আমাকে বলেছিলেন, তাদের কথামতো আমি যদি এই কাজগুলো না করি, তাদের ২ কোটি ৯ লাখ টাকা যদি আমি না দিই, তাহলে তারা আমার ঘুম হারাম করে দেবেন। এই হুমকি দিয়েছিলেন তারা। ২০১০ সালের আগে হুমকি দেওয়া হয়।’

আলোচনা-সমালোচনার পক্ষে-বিপক্ষে সাধারণ মানুষ ও মাসুদ রানা পাঠক থেকে শুরু করে অনেকেই জানিয়েছেন নিজস্ব মতামত। গল্পকার সাইফুল আমিন প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন এভাবে- ‘কাজীদার সৃষ্টি, মাসুদ রানা। সংক্ষেপে বলতে গেলে, যখন এর চাহিদা বিপুল, প্রতি মাসে একটা করে বই দরকার হয়, তখন ভাড়াটে লেখকের প্রয়োজন আসে। এই তালিকায় আবদুল হাকিমসহ অনেকেই আছেন। তারা যে যে কাহিনী লিখেছেন, তার স্বত্ব হিসেবে, বই বিক্রির সম্মানী পাবেন। এর মানে, চরিত্র মাসুদ রানার সৃষ্টি হাকিম সাহেব নন। ভাড়াটে লেখকরা যত দিন সম্মানীতে সন্তুষ্ট ছিলেন, তত দিন লিখেছেন। যেমন, তিন গোয়েন্দা থেকে অনেক আগেই রকিব হাসান ইস্তফা দিয়েছেন। বিষয় হচ্ছে, মাসুদ রানার যদি এই জনপ্রিয়তা সৃষ্টি না হত, তা হলে কেউই এই নিয়ে কথা তুলতেন না। যেভাবে চলে আসছে বিগত পঞ্চাশ বছর, তা-ই চলতো।’

ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ‘শুভেচ্ছা’ খ্যাত উপস্থাপক ডা. আবদুন নূর তুষার বলেন, ‘…কাজী আনোয়ার হোসেন এরই মধ্যে মাসুদ রানা ছবির জন্য মাসুদ পারভেজকে সত্তর দশকে বিস্মরণ দিয়েছেন। মাসুদ রানা নামটার কপিরাইট অবশ্যই কাজী আনোয়ার হোসেনের। শেখ আব্দুল হাকিম কাজী আনোয়ার হোসেনের কাছ থেকে এককালীন টাকা নিয়ে বেতনভোগীর মতো চাকরি করেছেন, তার অভিভাবকত্বে, কাজী আনোয়ারের লেখার স্টাইল অনুসরণ করে তারই সৃষ্ট বিভিন্ন চরিত্রদের নিয়ে মাসুদ রানার বিভিন্ন পর্ব লিখেছেন। তার নিজের নামে লিখলে বই কী হয় সেটা আমরা দেখেছি। তিনি বাইরে থেকে জাকি আজাদ নামে একটা সিরিজ লিখেছিলেন। জঘন্য সেই সিরিজ। জাকির আসল নাম, লোটন শিকদার। এই হলো কাজী আনোয়ার হোসেনের অভিভাবকত্ব না থাকলে, হাকিমের রুচিবোধ। তিনি ভয়াল নামে নিজের নাম দিয়ে সিরিজ লিখেছিলেন সেবা প্রকাশনী থেকে। সেটার নায়কের নাম ছিল ইমতিয়াজ, তার বন্ধু জিপ্পি আসাদ। সেটাও চলে নাই। ৯টা চলার পরে বিক্রি হয় না বলে বন্ধ হয়ে যায়। তাহলে কী করে শেখ আবদুল হাকিম মাসুদ রানা ও কুয়াশার কপিরাইট পান, যেখানে সিরিজের মূল চরিত্রের নামটাই তার দেওয়া না, চরিত্রটা সৃষ্টিও তিনি করেন নাই।’

সাংবাদিক ও টকশো আলোচক গোলাম মোর্তোজা নিজের অবস্থান জানান এভাবে- ‘…এখন কাজী আনোয়ার হোসেনকে যেভাবে ভিলেন বানানো হচ্ছে, তা তার প্রাপ্য না। তিনি লেখক শেখ আবদুল হাকিমদের কোনো ক্ষতি করেননি। যারা মাসুদ রানা লিখেছেন, তারা সবাই চরম আর্থিক বিপদের দিনে কাজী আনোয়ার হোসেন দ্বারা উপকৃত হয়েছেন। মেধাস্বত্বের দিকটি সামনে এসেছে। আইন যা বলবে তা সবাইকে মেনে নিতে হবে। কিন্তু কাজী আনোয়ার হোসেন ভিলেন আর শেখ আবদুল হাকিমকে নায়ক বানানো- সুস্থ স্বাভাবিক চিন্তা নয়। বিশ্লেষণটা সামগ্রিকভাবে সেই সময়কালের প্রেক্ষাপট বিবেচনায় রেখে হওয়া দরকার।’

রয়্যালিটি-স্বত্বের আলোচনা এমন সময়ে তুঙ্গে উঠেছে যখন বিগ বাজেটে নির্মিত হচ্ছে চলচ্চিত্র। স্পাই থ্রিলার ‘মাসুদ রানা’ অবলম্বনে নির্মিতব্য চলচ্চিত্রের মূল চরিত্রে অভিনেতা এবিএম সুমন ও নবনীতা চরিত্রে সৈয়দা তৌহিদা হক অমনি নামে এক মডেলকে চ‚ড়ান্ত করেছে প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান জাজ মাল্টিমিডিয়া। জাজ মাল্টিমিডিয়ার সঙ্গে হলিউডের সিলভারলাইনসহ আরও তিনটি প্রতিষ্ঠানের যৌথ প্রযোজনায় ৮৩ কোটি টাকা ব্যয়ে ছবিটি পরিচালনা করছেন হলিউডের পরিচালক আসিফ আকবর। করোনাভাইরাস পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেই লস এঞ্জেলস, বাংলাদেশ ও দক্ষিণ আফ্রিকায় সিরিজের প্রথম চলচ্চিত্রের শুটিং শুরুর পরিকল্পনার কথা জানানো হয়েছে।

জাজ মাল্টিমিডিয়া এবার মাসুদ রানা সিরিজের তিনটি উপন্যাসের চলচ্চিত্রায়নের স্বত্ব কিনে প্রথমে ১৯৬৬ সালে প্রকাশিত ‘ধ্বংস পাহাড়’ অবলম্বনে চলচ্চিত্র নির্মাণে হাত দিয়েছে। চিত্রনাট্য পরিমার্জন, পরিবর্তন ও পরিবর্ধন করেছেন আবদুল আজিজ, নির্মাতা আসিফ আকবর ও তরুণ থ্রিলার লেখক নাজিম উদ দৌলা।

‘মাসুদ রানা’ অবলম্বনে চার যুগ আগে বাংলাদেশে একটি চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছিল। সেখানে মাসুদ রানার ভ‚মিকায় ছিলেন সোহেল রানা। নায়িকা ছিলেন কবরী ও অলিভিয়া। মাসুদ রানা সিরিজের ‘বিস্মরণ’ অবলম্বনে নির্মিত ওই চলচ্চিত্রটি ব্যবসাসফল হয়েছিল।

সংশ্লিষ্টরা আশঙ্কা করছেন, মাসুদ রানা আদালত পর্যন্ত গড়ালে এর নেতিবাচক প্রভাব চলচ্চিত্রে পড়বে কিনা। আবার কেউ কেউ এটাও মনে করছেন, এসব তর্ক-বিতর্ক, বাদানুবাদে প্রকৃত পক্ষে ‘ব্র্যান্ডিং’ই হবে নির্মিতব্য চলচ্চিত্রটির! আদালতের রায় যা-ই হোক, আখেরে লাভবান হবে চলচ্চিত্রটি।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here