মেয়েটির প্রোফাইল ছবিতে দুটি মায়াবী চোখ। যে কেউ এই চোখ দুটি দেখলে সম্মোহিত হবে। তাই হয়তো এই আইডিতে প্রতিদিন প্রচুর রিকোয়েস্ট আসে। অবসর সময়ে সে প্রায় প্রতিটি আইডি খুলে দেখে। কিন্তু অধিকাংশ অনুরোধ তার পছন্দ হয় না।
একদিন কৃষ্ণ নামে একজনের অনুরোধ এলো। নিজের নামের অগ্রভাগ দেখতে পেয়ে আইডিটির প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠল। পেশাতেও মিল। অনুরোধ গ্রহণ করল।
বছর দুই হবে ফেসবুকে কৃষ্ণ-চূড়ার পরিচয়। প্রথমে বন্ধুত্ব, তারপর ধীরে ধীরে ঘনিষ্ঠতা। এই ঘনিষ্ঠতা একসময় প্রেম-ভালোবাসায় রূপ নিল। কৃষ্ণ ডাক্তার। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ থেকে ডাক্তারি পাশ করার পর উচ্চতর ডিগ্রি অর্জনের জন্য আমেরিকায় চলে যায়। এখন আমেরিকার নামকরা একটি হাসপাতালের হৃদরোগ বিভাগে কর্মরত। আমেরিকা যাওয়ার এক মাসের মধ্যে পৃথিবীতে তার একমাত্র আপনজন মা পাড়ি জমান না ফেরার দেশে। তখন ফিরে আসার মত অবস্থা ছিল না। মাকে শেষ দেখা সম্ভব হয়নি কৃষ্ণের। আর তারপর থেকে দেশে আসার আকর্ষণ অনুভব করেনি কৃষ্ণ। প্রায় আট বছর হবে সে প্রবাসী। কিন্তু চূড়া’র সাথে পরিচয়ের পর থেকে আবার কেমন যেন একটু একটু করে দেশের প্রতি আকর্ষণ অনুভব করছে সে।
চূড়া কৃশ-দীর্ঘাঙ্গী একজন নারী। মার্জিত রুচিসম্পন্ন, প্রচণ্ড ব্যক্তিত্ব নিয়ে চলাফেরা করে। মুখখানা মায়ায় ভরা। চূড়ার সবচেয়ে আকর্ষণীয় হল তার হরিণী চোখ জোড়া। মনে পড়ে প্রথম যেদিন ওরা ভিডিও কলে কথা বলছিল সেদিনই চূড়ার চোখের দিকে তাকিয়ে কৃষ্ণ মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিল। মনে হয়েছিল চোখগুলো কতদিনের চেনা। বছরখানেক হবে চূড়া চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ থেকে ডাক্তারি পাশ করেছে। এখন একটি প্রাইভেট হাসপাতালে চাকরি করছে। মা-বাবা, ছোট ভাইকে নিয়ে চট্টগ্রাম শহরের খুলশী আবাসিকের পৈত্রিক বাস ভবনে বসবাস করে। বাবাও ডাক্তার ছিলেন। বর্তমানে অবসর প্রাপ্ত। নির্ঝঞ্ঝাট পরিবার। আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, সহকর্মী সবাইকে নিয়ে বেশ ভালোই আছে।
কৃষ্ণ-চূড়ার অবসর সময় কাটে ভার্চুয়ালের বিভিন্ন মাধ্যমে। কখনো কখনো দু’জন সারারাত পার করে দেয়। ঘণ্টার পর ঘণ্টা একজন আরেকজনের সাথে কথা বলে, তাকিয়ে থাকে। চূড়ার পরিবার তাদের এই সম্পর্কের কথা জানে এবং সবকিছু জানার পর সম্মতিও দিয়েছে। তাই তাদের এই অবাধ আলাপচারিতা চলছে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস। এবার বিয়ের পিড়িতে বসার পালা। তাদের সম্পর্কের চূড়ান্ত পরিণতি দিতে অতি শীঘ্র কৃষ্ণ আসার কথা দেশে।
সারপ্রাইজ দেওয়ার জন্য চূড়াকে কিছুই জানায়নি কৃষ্ণ। গত রাতেই ঢাকা ল্যান্ড করেছে কৃষ্ণ, অতঃপর চট্টগ্রাম। হোটেল রয়েল ইন্টারন্যাশনাল-এ উঠেছে সে। আসার সময় বিয়ের অলঙ্কার, কসমেটিকস থেকে শুরু করে কাপড়চোপড় সবই কিনে এনেছে। দীর্ঘ ভ্রমণের পরও ততটা ক্লান্তি অনুভব করছে না। একটু ফ্রেশ হয়ে চূড়াকে কল করে। তখন ভোর। নিদ্রামগ্ন চূড়া কল রিসিভ করে। অপরপ্রান্ত থেকে কৃষ্ণের কণ্ঠ ভেসে এলো।
– কেমন আছো?
– ভালো। এত ভোরে? তুমি কেমন আছো?
– আমিও ভালো। তোমার সাথে সামনাসামনি দেখা করতে চাই।
চূড়া হতবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে
– কিভাবে?
-আজ সন্ধ্যায় হোটেল রয়েল ইন্টারন্যাশনাল-এর লবিতে।
চূড়ার বুঝতে আর কষ্ট হয় না। সানন্দে রাজি হয়ে গেল। তাছাড়া আজ তার ডিউটি অফ। হাতে প্রচুর সময়। তারপরও তাড়াহুড়ো করে উঠে গেল। মেয়ের এই অপ্রত্যাশিত জাগরণে মা বিস্মিত হল। কিন্তু মুখে কিছু বলল না। দুপুর থেকে নিজেকে পরিপাটি করে প্রস্তুত করেছিল চূড়া। পরিচয়ের পর এই প্রথম মুখোমুখি দেখা হবে দু’জনের। তাই মনে মনে বেশ রোমাঞ্চ অনুভব করছিল। তাছাড়া কিছুদিনের মধ্যে ওদের বিয়ে। মধুময় স্বপ্নের জাল আচ্ছন্ন করল চূড়ার মনকে। দিদির হঠাৎ এমন সাজগোজ দেখে ছোটভাইটা অনেক দুষ্টুমি করে গেল। মা-বাবা, কোথায় যাচ্ছে জানতে চাইল। সলজ্জ চূড়া কৃষ্ণের দেশে আসার খবরটা জানাল। মা, কৃষ্ণকে বাসায় নিয়ে আসার জন্য বলল । চূড়া মাথা নাড়ল।
নির্দিষ্ট সময়ের একটু আগেই বেরিয়ে পড়ল সে। হোটেলে পৌঁছতে বেশি সময় লাগলো না। গাড়ী থেকে নেমেই দেখল কৃষ্ণ দাঁড়িয়ে আছে। চিনতে এতটুকু কষ্ট হল না। যেন কতদিনের পরিচিত। কৃষ্ণ হাসিমুখে হাত বাড়িয়ে দিল এবং চূড়ার বাম হাতটা ধরল। ভরাট গলায় বলল- এসো। লবিতে ওদের জন্য নির্ধারিত আসনে মুখোমুখি বসল দু’জন। চূড়া কিছুটা আড়ষ্টতা নিয়ে কৃষ্ণের দিকে তাকাল। দেখল, কৃষ্ণ মন্ত্রমুগ্ধের মত চূড়ার দিকে তাকিয়ে আছে। উচ্চশিক্ষিতা চূড়া এই দৃষ্টির সামনে নিজের দৃষ্টি আনত করে জিজ্ঞেস করল- অত কি দেখছ?
– আমার মায়ামৃগকে। মৃদু হাসল কৃষ্ণ। ইতোমধ্যে বেয়ারা ফলের জুস দিয়ে গেল। একটু একটু জুস পান করতে করতে বিভিন্ন বিষয়ে আলাপ করল দু’জন। প্রাধান্য পেল বিয়ের তারিখ, বিয়ের কেনাকাটা এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা। দেখতে দেখতে অনেক সময় গড়িয়ে গেল। ডিনার সার্ভ করা হল। আলোআঁধারি পরিবেশে ওরা ডিনার শেষ করল। এবার বিদায়ের পালা। কৃষ্ণ পকেট থেকে একটি ছোট্ট সুদৃশ্য বাক্স বের করে চূড়ার হাতে দিল। চূড়া আলতোভাবে বাক্সটি খুলল। চূড়ার দু’চোখে ঝিলিক। হীরা বসানো সোনার ব্রেসলেট।
– পরো। অনুরোধ কৃষ্ণের।
চূড়া ডানহাতে পরে নিল। বেশ মানিয়েছে। কৃষ্ণ চূড়ার দু’টি কোমল হাত নিজের পুরুষ্ট হাতের মধ্যে তুলে নিয়ে দু’টি মায়াবী চোখের দিকে তাকিয়ে থাকল।
– তোমার হরিণী চোখ জোড়ার দিকে তাকালে আমার বুকের ভেতর কেমন যেন হৃৎস্পন্দন বেড়ে যায়।
– এ চোখ তো আমার নয়। একজন স্বর্গীয় দেবীর, তাই হয় তো।
মুখে দুষ্টুমির হাসি হেসে বলল চূড়া। চূড়ার এমন হেয়ালি ভরা উত্তরে সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে তাকায় কৃষ্ণ।
– এইচএসসি’র রসায়ন ব্যবহারিক পরীক্ষা।
ভাবলেশহীন বলতে থাকে চূড়া।
– শেষ পরীক্ষা ছিল। শেষ পর্যায়ে হঠাৎ রাসায়নিক পরীক্ষা করতে গিয়ে কী থেকে কী যেন হয়ে গেল। আমি চোখে দেখতে পাচ্ছিলাম না। অন্ধ হয়ে গেলাম। ডাক্তার দেখানো হল। বলল, কর্নিয়া রিপ্লেস করতে হবে। খোঁজ শুরু হল। এমন সময় দেবীর মত আমার জীবনে এলেন এক নারী। মৃত্যুর আগে উনার চোখ দু’টি দান করে গেলেন। আমিও নতুনভাবে জীবন ফিরে পেলাম।
তারপর আরো বিস্তারিত বলল সে। একনাগারে সব কথা শেষ করে থামল চূড়া। কৃষ্ণের হাত জোড়া বার কয়েক কেঁপে উঠল। বুকের ভেতরটা মোচড় দিল। বাইরের উন্মুক্ত শীতল হাওয়াতেও ঘামছিল কৃষ্ণ। উতালপাতাল করছিল অতীত-বর্তমান। কিন্তু চূড়াকে কিছুই বুঝতে দিল না। আরো কিছুসময় অতিবাহিত হওয়ার পর বিদায় চাইল চূড়া। আগামীকাল ওদের বাসায় যাওয়ার নিমন্ত্রণ করতে ভুলল না। কৃষ্ণ গাড়ীতে তুলে দিয়ে হাসি মুখে শুভ রাত্রি জানাল। প্রত্যুত্তরে শুভ রাত্রি জানাল চূড়া।
নিজের রুমে ফিরে এসে সরাসরি বিছানায় গা এলিয়ে দিল কৃষ্ণ। কিন্তু কিছুতেই ঘুম এলো না। বার বার অতীত এসে সামনে দাঁড়াল। কি জানি কি এক শঙ্কায় সারারাত এপাশ ওপাশ করে কাটিয়ে দিল।
খুব ভোরে বিছানা ছাড়ল। স্নান সেরে বাইরে বেরুনোর জন্য তৈরি হয়ে গেল। অত ভোরে নিশ্চয় হাসপাতালের অফিসিয়াল কার্যক্রম শুরু হয় না। তারপরও কিছুতেই তর সইছিল না। ব্রেকফাস্ট করে ন’টার মধ্যে বেরিয়ে গেল। পাহাড়তলী চক্ষু হাসপাতাল। আধঘণ্টার মতো লাগল। সরাসরি পরিচালকের কক্ষে গিয়ে উপস্থিত হল। পরিচালক কক্ষেই ছিলেন। শুভ সকাল জানিয়ে পরিচালকের সাথে করমর্দন করল কৃষ্ণ এবং নিজের একটি ভিজিটিং কার্ড এগিয়ে দিল। পরিচালক মহোদয় হাসিমুখে বসতে বললেন।
– বলুন, আপনার জন্য কী করতে পারি?
কৃষ্ণ বিস্তারিত সবকিছু খুলে বলল। সন, তারিখ সব। পরিচালক কলিং বেল ছাপলেন। পিয়ন এলো। একটি চিরকুট লিখে পিয়নের হাতে দিয়ে রেকর্ড বুকটা আনতে বললেন। ইত্যবসরে পরিচালকের সাথে চিকিৎসা সম্পর্কীয় বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলাপ হচ্ছিল। চা-বিস্কুট এলো। অনিচ্ছা সত্বেও চায়ে চুমুক দিল কৃষ্ণ। উত্তেজনায় কৃষ্ণের শরীর কাঁপছিল। আর মনে মনে অদৃশ্য শক্তির কাছে প্রার্থনা করছিল, সে যা ভাবছে তা যেন না হয়। এক একটি মিনিট যেন এক একটি বছর। বেশি সময় লাগল না পিয়ন ফিরে এলো। পরিচালকের হাতে রেকর্ডবুক তুলে দিয়ে বাইরে চলে গেল। পরিচালক পাতা উল্টে চলেছেন এবং নির্ধারিত পাতাটিতে গিয়ে থামলেন। পাতাটি উপর চোখ বুলালেন। তারপর কৃষ্ণের দিকে এগিয়ে দিলেন। কৃষ্ণের চোখ ঝাপসা হয়ে এলো। অনেক কষ্টে পড়ল –
‘চক্ষুদাতা- মৃন্ময়ী দেবী’
‘গ্রহীতা – শ্রেয়া চৌধুরী (চূড়া)’
কৃষ্ণ আর পড়তে পারল না। বুকটা ভারী হয়ে এলো। দু’চোখ উপচে জলধারা বেরিয়ে আসতে চাইল। নিজেকে কোনোরকমে সম্বরণ করে নিল। পরিচালককে ধন্যবাদ জানিয়ে হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে এলো। তারপর সোজা হোটেল। রুমে ঢুকে অঝর ধারায় কাঁদল কৃষ্ণ। মায়ের চোখ দান করার ঘটনাটি তার দূর সম্পর্কের এক আত্মীয়ের মাধ্যমে জেনেছিল সে। কিন্তু এতটা বছরে তা বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে গিয়েছিল। এই মুহূর্তে চূড়ার চোখ দুটি বার বার চোখের সামনে ভেসে উঠতে লাগল যা তার মায়ের চোখ। জীবনকে সব সময় সব কিছুর উপরে স্থান দিয়েছে কৃষ্ণ। জীবনে প্রতিষ্ঠা পেতে অনেক সংগ্রাম করেছে সে। কিন্তু জীবন নিয়ে এমন দোলাচলে তাকে পড়তে হবে তা কখনো ভাবেনি। এখন কী করবে কৃষ্ণ? সে কি আগের মত চূড়ার দু’চোখের দিকে প্রেমিকের তৃষ্ণার্ত চোখে তাকাতে পারবে? তাকাতে পারবে কি কামনার কাঙ্ক্ষিত দৃষ্টিতে?
ক্রিং ক্রিং। চূড়ার কল। মোবাইল স্ক্রিনে ভেসে উঠল অসম্ভব সুন্দর দুটো মায়াবী চোখ। কৃষ্ণ সেই চোখ দু’টির দিকে ভাবালেশহীনভাবে তাকিয়ে থাকল।
চমৎকার লিখেছ